Ajker Patrika

দীপের আলো জ্বলবে তো

রোকনুজ্জামান মনি, ঢাকা
Thumbnail image

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে ফুটপাতে ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসেন মাঝবয়সী মিতালি বেগম। পাশেই বসে পড়াশোনা করে তাঁর ছয়-সাত বছর বয়সী ছেলে দীপ। একই জায়গায় বসে এক দিকে মা করেন জীবিকার লড়াই, অন্যদিকে ছেলের চলে লেখাপড়া করার সংগ্রাম। এমন দৃশ্য দেখে অনেকের চোখ আটকে যায় তাদের ওপর। সে জন্যই হয়তো প্রয়োজন না থাকলেও ওজন মাপাতে আসেন অনেকে, খোঁজ নেন তাদের। জানতে চান মা-ছেলের জীবনসংগ্রামের গল্প। এগুলো ভালোই লাগে মিতালি বেগমের।

গাড়ির হর্ন, মানুষের চিৎকার, অশালীন কথাবার্তা সবকিছু সয়ে জীবনের চাকা ঘুরিয়ে চলেন মিতালি। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁর নিত্যদিনের জীবনযাপন। জীবনের এই কঠিন অবস্থাতেও ছেলের হাতে অনেকের মতো তুলে দেননি ভিক্ষার থলে। বরং ছয় বছরের ছেলে দীপকে পড়াচ্ছেন মাদার তেরেসা স্কুলে। সে এবার পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে। ক্লাস শেষ করেই মায়ের কাছে ছুটে আসে দীপ। রাস্তার পাশে বসেই খাওয়া-দাওয়াসহ হয় দুপুরের ঘুম। বিকেল হলেই নিয়ম করে পড়াতে বসান মিতালি বেগম। নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছোট্ট ব্যবসা সামলে দ্বীপকে পড়াশোনা শেখাতেই সময় চলে যায় তাঁর। ফলে অন্য কিছু নিয়ে ভাবনার সময় পান না মিতালি।

কেমন চলছে আপনাদের জীবন—জানতে চাইলে মিতালি জানালেন অনেক কথা। দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে ছেলেকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘরে থাকেন। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে দু-পাঁচ শ টাকা সাহায্য করেন। সরকার থেকেও একবার পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। সেই টাকায় দীপকে স্কুলে পড়াশোনা করান। তবে স্থায়ী কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি মিতালি। 
১৯৯৯ সালে নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন মিতালি। অচেনা শহরে এসে পরিচয় হয় চাঁদপুর থেকে আসা মুজিবুল হকের সঙ্গে। সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে দেখা করতেন তাঁরা। একসময় তাঁদের মধ্যে তৈরি হয় ভালো লাগা। করে ফেলেন বিয়ে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে ২০১৬ সালে তাঁদের কোলজুড়ে আসে ছেলে দীপ। তবে ছেলে জন্ম নেওয়ার ছয় মাসের মাথায় স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে চলে যান মুজিবুল। এরপর আর কোনো খোঁজ নেননি।

একদিকে মুজিবুল যেমন তাঁদের ছেড়ে চলে গেছেন, অন্যদিকে ভাগ্যও মিতালি বেগমকে বসিয়ে দিয়েছে পথে। আমার প্রশ্নের উত্তরে একমনে তিনি যা বলে গেলেন তার অর্থ—দিন কোনোমতে চলে যাবে। হয়তো একবেলা খেয়ে থাকতে হবে, বৃষ্টির পানি মাথায় নিয়ে ঘুমাতে হবে। কিন্তু নিজেকে আর ছেলেকে ভাগ্যের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে নারাজ মিতালি। কষ্ট হলেও ছেলের জীবন গড়ে দিতে চান তিনি।

দীপের কাছে জানতে চাইলাম, বড় হয়ে কী হতে চায় সে। ক্লান্ত শরীর আর ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডলের মলিন চাহনি নিয়ে ছেলের হয়ে মিতালিই উত্তর দিয়ে দিলেন। জানালেন, ছেলেকে কৃষি অফিসার বানাতে চান তিনি।

পায়ের ওপর ভর দিয়ে চুপচাপ মিতালি বেগমের মুখোমুখি বসে আছি। দীপ বলে উঠল, ‘মা, লেখা শেষ।’ খাতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এক পৃষ্ঠা ইংরেজি বর্ণমালা লিখেছে সে। তবে দু-একটি জায়গায় কাটাকুটি হয়েছে। মিতালি বেগম হাতে খাতাটা নিয়ে কাটাকুটি হওয়া জায়গায় গোল দাগ দিয়ে পুরো খাতাজুড়ে একটা বড় সাইন দিলেন। আমিও আসি বলে উঠে পড়লাম। ফুটপাত ধরে হাঁটছি আর ভাবছি, এই শহর অনেকের স্বপ্ন পূরণ করে। দীপ আর মিতালির স্বপ্ন কি পূরণ হবে না? 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত