ড. মইনুল ইসলাম
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। সম্প্রতি গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স কান্ট্রি র্যাঙ্কিং ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর ‘ট্রেইস ইন্টারন্যাশনাল’ নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এই র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। ২০২১ সালের র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে ঘুষের ঝুঁকির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত), আফগানিস্তানের অবস্থান সর্বনিম্ন, ১৭৪ নম্বরে। পাকিস্তানের র্যাঙ্ক তৃতীয় সর্বনিম্ন, ১৫০ নম্বরে, মালদ্বীপের অবস্থান ১১৮ নম্বরে, নেপাল ১১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৯২ নম্বরে, ভারত ৮২ নম্বরে এবং ভুটান ৬২ নম্বরে।
এর মানে, ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নির্ণীত হয়েছে, আফগানিস্তান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এর আগে বার্লিনে অবস্থিত দুর্নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং প্রদত্ত হয়েছে। এই ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬ (নিচের দিক থেকে দ্বাদশ), পাকিস্তানের অবস্থান ১২৪, নেপালের ১১৭, শ্রীলঙ্কার ৯৪ এবং ভারতের ৮৬। এই র্যাঙ্কিং অনুসারেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান, যার অবস্থান ১৬৫ নম্বরে।
টিআইয়ের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নির্ণীত হয়েছে সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। উল্লিখিত দুটো র্যাঙ্কিংয়ে দেশের সংখ্যা এবং ঘুষ-দুর্নীতিতে দেশগুলোর অবস্থান আলাদা হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনামূলক ঘুষ-দুর্নীতির চিত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুটো র্যাঙ্কিংই দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এ সপ্তাহে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ১০০ নম্বরের মধ্যে ২৬ নম্বর পেয়ে বিশ্বে ত্রয়োদশ অবস্থানে রয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ২০২০ সালের স্কোর এবং ২০২১ সালের স্কোর একই রয়ে গেছে, কোনো উন্নতি হয়নি। তার মানে, বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঘুষ-দুর্নীতির দিক থেকে এখনো সবচেয়ে খারাপ অবস্থানের দেশগুলোর কাতারেই রয়ে গেছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা মোতাবেক দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ আর ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৭-৮ সালে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের ‘প্রবল ঝাঁকি’ দেওয়ায় বাংলাদেশের ভাগ্যে দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর না জুটলেও আমাদের অবস্থান এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১৫টি দেশের মধ্যেইঘুরপাক খাচ্ছে।
এই পর্যায়ে স্মরণ করছি, ২০০৭-০৮ সালের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রবল গতিশীলতা অর্জন করেছিল, সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। দুদকের পাশাপাশি মেজর জেনারেল মতিনের নেতৃত্বাধীন অধিক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী জাতীয় কমিটিও রাজনীতিবিদ ও রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল ওই সময়; ডিজিএফআই এর তদন্ত পরিচালনা করার কারণে রাঘববোয়ালরা ভয়ে তটস্থ থাকত। ওই দুই বছরে এই দুই ধরনের দুর্নীতিবাজদের যে প্রবল ঝাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেটা দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর ওই সময়টায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারকে দুর্নীতি দমনে সত্যিকার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল আমার কাছে। দুঃখজনক হলো, ২০০৯ সাল থেকেই পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে প্রবল হাওয়া লেগেছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডবে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ধনাত্মক রয়ে গেছে, যেটা ভারতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির তুলনায় অবশ্যই প্রশংসনীয়।
কিন্তু দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সর্বনাশা বিস্তৃতির কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির এই সাফল্যের সুফল যে সমাজের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জমান সামরিক কর্মকর্তারাই একতরফা দখলে নিয়ে যাচ্ছেন, তারই অকাট্য প্রমাণ ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আরেকটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের মাধ্যমে। ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অর্জন।
কারণ, ধনকুবেরদের সম্পদের প্রবল স্ফীতির অর্থই হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এবং ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। এই ন্যক্কারজনক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়ছে না।
বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে তাঁদের অতীতের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন না করে; বরং এখন দেশের অর্থনীতি পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে! দেশের বর্তমান সংসদ সদস্যদের ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকেরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাত্ কা বাত’ বানিয়ে না ফেলে! এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম আমরা? আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, সরকারের এহেন ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম-প্রীতি’ অসাংবিধানিক ও অনৈতিক।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু সমরপ্রভু জিয়া নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর সচেতন আশকারা পেয়েই তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুণ্ঠন প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছিল, তাঁর আমল থেকেই এগুলো বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সর্বনাশা স্তরে পৌঁছে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রক্রিয়াগুলো স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩১ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে দেশে অনেকগুলো ‘মেগা-প্রজেক্ট’সহ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মহাযজ্ঞ চলছে, আর ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতা-কর্মীরা এই প্রকল্পগুলো থেকে বেধড়ক পুঁজি-লুণ্ঠন করেছেন। দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় এই ৪৭ বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিও বেড়ে পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে। এই সরকারব্যবস্থাকেই উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা চৌর্যতন্ত্র (kleptocracy) কিংবা ‘পুঁজি-লুণ্ঠনমূলক সরকার’ (extractive government) আখ্যায়িত করা হয়।
দুঃখজনক হলো যে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও সরকার দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা দেখায়নি। অথচ ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশই লুটেরা পুঁজির ফায়দাভোগী হয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছের’ রূপ ধারণ করেছে। তাদের একটা অংশ জনমনে ভীতি-সঞ্চারকারী ‘গডফাদারে’ পরিণত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে আপনি ইতিহাসে যে স্থান করে নিয়েছেন, সেটাকে ‘টেকসই’ করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ যুদ্ধেও আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। সম্প্রতি গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স কান্ট্রি র্যাঙ্কিং ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর ‘ট্রেইস ইন্টারন্যাশনাল’ নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এই র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। ২০২১ সালের র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে ঘুষের ঝুঁকির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত), আফগানিস্তানের অবস্থান সর্বনিম্ন, ১৭৪ নম্বরে। পাকিস্তানের র্যাঙ্ক তৃতীয় সর্বনিম্ন, ১৫০ নম্বরে, মালদ্বীপের অবস্থান ১১৮ নম্বরে, নেপাল ১১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৯২ নম্বরে, ভারত ৮২ নম্বরে এবং ভুটান ৬২ নম্বরে।
এর মানে, ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নির্ণীত হয়েছে, আফগানিস্তান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এর আগে বার্লিনে অবস্থিত দুর্নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং প্রদত্ত হয়েছে। এই ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬ (নিচের দিক থেকে দ্বাদশ), পাকিস্তানের অবস্থান ১২৪, নেপালের ১১৭, শ্রীলঙ্কার ৯৪ এবং ভারতের ৮৬। এই র্যাঙ্কিং অনুসারেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান, যার অবস্থান ১৬৫ নম্বরে।
টিআইয়ের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নির্ণীত হয়েছে সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। উল্লিখিত দুটো র্যাঙ্কিংয়ে দেশের সংখ্যা এবং ঘুষ-দুর্নীতিতে দেশগুলোর অবস্থান আলাদা হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনামূলক ঘুষ-দুর্নীতির চিত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুটো র্যাঙ্কিংই দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এ সপ্তাহে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ১০০ নম্বরের মধ্যে ২৬ নম্বর পেয়ে বিশ্বে ত্রয়োদশ অবস্থানে রয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ২০২০ সালের স্কোর এবং ২০২১ সালের স্কোর একই রয়ে গেছে, কোনো উন্নতি হয়নি। তার মানে, বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঘুষ-দুর্নীতির দিক থেকে এখনো সবচেয়ে খারাপ অবস্থানের দেশগুলোর কাতারেই রয়ে গেছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা মোতাবেক দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ আর ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৭-৮ সালে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের ‘প্রবল ঝাঁকি’ দেওয়ায় বাংলাদেশের ভাগ্যে দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর না জুটলেও আমাদের অবস্থান এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১৫টি দেশের মধ্যেইঘুরপাক খাচ্ছে।
এই পর্যায়ে স্মরণ করছি, ২০০৭-০৮ সালের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রবল গতিশীলতা অর্জন করেছিল, সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। দুদকের পাশাপাশি মেজর জেনারেল মতিনের নেতৃত্বাধীন অধিক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী জাতীয় কমিটিও রাজনীতিবিদ ও রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল ওই সময়; ডিজিএফআই এর তদন্ত পরিচালনা করার কারণে রাঘববোয়ালরা ভয়ে তটস্থ থাকত। ওই দুই বছরে এই দুই ধরনের দুর্নীতিবাজদের যে প্রবল ঝাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেটা দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর ওই সময়টায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারকে দুর্নীতি দমনে সত্যিকার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল আমার কাছে। দুঃখজনক হলো, ২০০৯ সাল থেকেই পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে প্রবল হাওয়া লেগেছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডবে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ধনাত্মক রয়ে গেছে, যেটা ভারতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির তুলনায় অবশ্যই প্রশংসনীয়।
কিন্তু দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সর্বনাশা বিস্তৃতির কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির এই সাফল্যের সুফল যে সমাজের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জমান সামরিক কর্মকর্তারাই একতরফা দখলে নিয়ে যাচ্ছেন, তারই অকাট্য প্রমাণ ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আরেকটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের মাধ্যমে। ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অর্জন।
কারণ, ধনকুবেরদের সম্পদের প্রবল স্ফীতির অর্থই হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এবং ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। এই ন্যক্কারজনক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়ছে না।
বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে তাঁদের অতীতের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন না করে; বরং এখন দেশের অর্থনীতি পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে! দেশের বর্তমান সংসদ সদস্যদের ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকেরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাত্ কা বাত’ বানিয়ে না ফেলে! এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম আমরা? আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, সরকারের এহেন ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম-প্রীতি’ অসাংবিধানিক ও অনৈতিক।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু সমরপ্রভু জিয়া নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর সচেতন আশকারা পেয়েই তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুণ্ঠন প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছিল, তাঁর আমল থেকেই এগুলো বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সর্বনাশা স্তরে পৌঁছে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রক্রিয়াগুলো স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩১ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে দেশে অনেকগুলো ‘মেগা-প্রজেক্ট’সহ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মহাযজ্ঞ চলছে, আর ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতা-কর্মীরা এই প্রকল্পগুলো থেকে বেধড়ক পুঁজি-লুণ্ঠন করেছেন। দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় এই ৪৭ বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিও বেড়ে পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে। এই সরকারব্যবস্থাকেই উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা চৌর্যতন্ত্র (kleptocracy) কিংবা ‘পুঁজি-লুণ্ঠনমূলক সরকার’ (extractive government) আখ্যায়িত করা হয়।
দুঃখজনক হলো যে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও সরকার দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা দেখায়নি। অথচ ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশই লুটেরা পুঁজির ফায়দাভোগী হয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছের’ রূপ ধারণ করেছে। তাদের একটা অংশ জনমনে ভীতি-সঞ্চারকারী ‘গডফাদারে’ পরিণত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে আপনি ইতিহাসে যে স্থান করে নিয়েছেন, সেটাকে ‘টেকসই’ করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ যুদ্ধেও আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
৯ দিন আগেবিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪