Ajker Patrika

সতীন সেন ভাষা আন্দোলনের আরেক শহীদ

ড. এম আবদুল আলীম
সতীন সেন ভাষা আন্দোলনের আরেক শহীদ

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা আবেগদীপ্ত হই। স্মরণ করি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের নানা ঘটনা এবং এই ইতিহাসনির্মাতাদের। সময়-সময় নকলদের ভিড়ে আসল নামগুলো বিস্মৃত হতেও দেখা যায়।

অন্তঃসত্ত্বা মা ভাষা আন্দোলনের মিছিলে হেঁটেছেন, মায়ের সেই সন্তান এখন নিজেকে এক অর্থে ভাষাসংগ্রামী দাবি করে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে! এমন বক্তৃতাও নিজ কানে শুনতে পাই এ দেশে! অথচ ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করা অনেক শহীদের নাম-পরিচয় আমরা উদ্ধার করতে পারিনি, পারিনি তাঁদের স্মৃতি পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে।

ভাষার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে অনেকে পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন, কেউ কেউ হুলিয়া মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর আত্মগোপনে থেকেছেন, অনেকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যৌবনের সোনালি দিনগুলো অতিবাহিত করেছেন, কেউ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়েছেন, কেউ আবার অত্যাচার-নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন এবং জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হয়েছে অনেকের।

আর এত যে ত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাকে কি আমরা সর্বস্তরে প্রচলনের ব্যবস্থা করতে পেরেছি? সেই আত্মত্যাগকারীদের কি প্রকৃত মর্যাদায় আমরা অধিষ্ঠিত করতে পেরেছি? কেন আমাদের এই বিস্মৃতি? কেন ভুলে যাওয়া? এটাই কি প্রাপ্য ছিল ভাষাসংগ্রামীদের? এতসব প্রশ্ন মাথায় এল একজন বিস্মৃতপ্রায় ভাষাসংগ্রামী সম্পর্কে লিখতে বসে। এই ভাষাসংগ্রামীর নাম সতীন্দ্রনাথ সেন। ছিলেন বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতি এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য।

সতীন্দ্রনাথ সেন ওরফে সতীন সেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবদীপ্ত নাম। জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল ফরিদপুরের কোটালীপাড়ায় (বর্তমান গোপালগঞ্জ)। পিতা নবীন সেন ছিলেন পটুয়াখালীর নামকরা মোক্তার। অল্প বয়সে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়ায় ১৯১১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হলেও লেখাপড়ায় আর অগ্রসর হতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ-রদের আন্দোলনে সক্রিয়তা থেকে ধীরে ধীরে নাম লেখান বিপ্লবীদের খাতায়। ১৯১১ সালে গুপ্ত সমিতির সদস্য হন এবং পটুয়াখালীতে বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। ১৯১৫ সালে বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ডাকাতিতে যুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার ও কারা নির্যাতন ভোগ করেন।

মুক্তির পর আবারও গ্রেপ্তার হন ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। কংগ্রেসের বরিশাল জেলার অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯২৬ ও ২৭ সালে পরপর দুবার গ্রেপ্তার ও কারাভোগ করেন। পরবর্তীকালে ‘লবণ আন্দোলন’ এবং ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে পরাজিত করে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর অনেকেই দেশত্যাগ করলেও তিনি স্বদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে এখানেই রাজনীতি ও জনসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে বারবার গ্রেপ্তার ও দুর্বিষহ কারা নির্যাতন ভোগ করে অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজা উড়িয়ে তথাকথিত পাকিস্তানি তমদ্দুন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। প্রথমে পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিপ্রেমী বুদ্ধিজীবীরা এর প্রতিবাদ করলেও ধীরে ধীরে তা রাজপথের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ক্রমে ছাত্রসমাজ থেকে চূড়ান্ত পর্বে পূর্ববঙ্গের সর্বস্তরের মানুষ ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়।

গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভাষা আন্দোলন বেগবানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তান গণপরিষদ এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বিরোধীদলীয় সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যরা।

বস্তুত ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষাবিষয়ক সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হওয়ার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। কেবল আইন পরিষদে নয়, আইন পরিষদের বাইরেও কংগ্রেস নেতারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার থাকেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে হতাহতের প্রতিবাদ জানান। অনেকে পুলিশি নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হন। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নির্যাতিতদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন আইন পরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য সতীন্দ্রনাথ সেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে হতাহতের পর পূর্ববঙ্গের রাজপথের মতো আইন পরিষদও উত্তাল হয়ে ওঠে। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখের সঙ্গে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নেলী সেনগুপ্তা, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, গোবিন্দলাল ব্যানার্জি, সতীন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ আইন পরিষদের অধিবেশন ত্যাগ করে হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে যান।

অনেক সদস্য ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে প্রতিবাদ করেন। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় আইন পরিষদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের।

গ্রেপ্তার করা হয় কংগ্রেসদলীয় তিনজন আইন পরিষদ সদস্যকে—মনোরঞ্জন ধর, গোবিন্দলাল ব্যানার্জি ও সতীন্দ্রনাথ সেনকে।ননিরাপত্তা অরডিন্যান্স অনুযায়ী, সতীন্দ্রনাথ সেনকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। গ্রেপ্তারের পর প্রথমে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয় এবং পরে স্থানান্তর করা হয় রংপুর কারাগারে। কারা নির্যাতনে তাঁর স্বাস্থ্যের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে।

এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলে মাইনরিটি মিনিস্টারের নির্দেশে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে তদন্ত করা হয়। তাঁর গ্রেপ্তার ও আটক নিয়ে ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়। এ বিষয়ে তিনি জেল ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য যখন জেলে ছিলাম, তখন পত্রিকায় আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কিছু লেখালেখি হওয়ায় এবং বোধ হয় মাইনরিটি মিনিস্টারের তরফ হইতে নির্দেশ আসায় আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তদন্ত হয়। এরপর মুক্তি দিয়ে ১৯৫৪ সালের ১ জুন আবারও গ্রেপ্তার করা হয়।’

শেষবার যখন জেল থেকে মুক্তি মেলে, তখন তাঁর চিরমুক্তির ডাক আসে। ধারাবাহিক নির্যাতনে কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী তাঁর আত্মজীবনীতে সতীন্দ্রনাথ সেনকে ‘ভাষা আন্দোলনের আরেক শহীদ’ বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবেই তিনি ভাষা আন্দোলনের আরেক শহীদ।

কারণ ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘ কারা নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়। পূর্ববঙ্গ সরকার প্রেসনোটের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর ব্যাখ্যা দেয়। ওই সময় কলকাতার সাপ্তাহিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘সতীন সেনের মৃত্যু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘প্রবীণ জননায়ক সতীন সেনের মৃত্যুতে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রেসনোটে বলা হয়েছে, “তিনি রক্তাল্পতা, ওজন হ্রাস ও শ্বাসযন্ত্রে রক্ত জমাটজনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন।”

তাঁর অবস্থা কখনোই গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেনি।’ প্রেসনোটে আরও বলা হয়েছে, ‘তাঁকে মুক্তিদানের পর এত শিগগির হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের দরুন তাঁর যে আকস্মিক মৃত্যু ঘটল, এই খবর দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। ৬১ বৎসর বয়স্ক সতীন সেনের প্রায় ৩১ বৎসরই কারাগারে কেটেছে। স্বাধীনতার পূর্বে সাড়ে সাতাশ বৎসর কেটেছে ইংরেজের জেলে, বাকি সাড়ে তিন বছর আজাদ পাকিস্তানের জেলে।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আজাদ পাকিস্তান সরকারের তল্পিবাহকরা ৬১ বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ বন্দীর কঠিন ব্যাধিতে কদাপি উদ্বেগ বোধ করেননি।...ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে সতীন বাবুর শেষ দিনগুলো কাটে। এবং মৃত্যুর দেড় ঘণ্টা পূর্বে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।’

সতীন্দ্রনাথ সেনের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বাংলা ভাষা কেবল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাই লাভ করেনি, তাঁদের ত্যাগের পথ ধরে গড়ে ওঠা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমে স্বাধিকার-আন্দোলনে রূপলাভ করে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি অর্জন করেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। সতীন্দ্রনাথ সেন অমর, ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবে তাঁর আত্মত্যাগের মহিমা।

লেখক: ড. এম আবদুল আলীম,সাবেক ডিন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, বেশির ভাগই ভারতীয়, আছে বাংলাদেশিও

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত