Ajker Patrika

ঐতিহাসিক হাটের ঐতিহ্যবাহী খাবার

রাতুল মণ্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর) 
আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২২, ১২: ০৬
ঐতিহাসিক হাটের ঐতিহ্যবাহী খাবার

সারি সারি দোকানের সারি সারি তন্দুরে গনগনে আগুনের তাপে তৈরি হচ্ছে রুটি। সেগুলো ঠিক বাড়িতে ভাজা ফুলকো রুটি নয়। একটু মোটা ও বড়। কাঠের আগুনের তাপে ফুলে ওঠা এসব রুটি খাওয়া হয় গুড়, গুড়ের গরম জিলাপি কিংবা ডাল দিয়ে। কেজি অথবা পিস যেকোনোভাবেই কেনা যায় এই রুটি। প্রতিদিন দলে দলে মানুষ এই তন্দুরি রুটি খেতে ভিড় করে বরমী বাজারে। আর হাটের দিন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রুটি খেতে হয়।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়ন। এখানেই আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো বরমী হাট। এই হাটের আশপাশে অনেক গ্রাম। প্রতি সপ্তাহের বুধবার এসব গ্রামের শিশুদের আনন্দের দিন। কারণ সপ্তাহের অন্যান্য দিন না হলেও বুধবার তারা নানা বা দাদার হাত ধরে বরমী হাটে যাবে। এখানে আসার অনেক উদ্দেশ্যের একটি হলো তন্দুরি রুটি খাওয়া। ৪০০ বছরের বেশি বয়সী বরমী হাটের তন্দুরি রুটি এ অঞ্চলের সব বয়সী মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়।

বরমী হাটে ঠিক কত বছর আগে তন্দুরি রুটি বানানো ও বিক্রি শুরু হয়েছে সে তথ্য নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। কিন্তু এখন বরমী হাটের বিরাট একটি অংশে অর্ধশতাধিক তন্দুরি রুটির দোকান। এসব দোকানে শত শত মানুষ প্রতিদিন লাইনে ধরে এই রুটি কিনে খায় আখের গুড়, গুড়ের জিলাপি কিংবা ডাল দিয়ে। যুগের পর যুগ অতিবাহিত হলেও স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলার মানুষের কাছে এখনো তন্দুরি রুটির কদর রয়েছে ভীষণ।

সপ্তাহের প্রতি বুধবার বরমীতে সাপ্তাহিক হাট বসে। সম্প্রতি এক বুধবার বরমী হাটে গিয়ে দেখা গেল, সকাল থেকে তন্দুরি রুটির দোকানে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে রুটি বানানোর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুটি খেতে দোকানগুলোতে ভিড় বাড়তে থাকে নানা বয়সী মানুষের। প্রতিটি দোকানে এক বা একাধিক তন্দুর রয়েছে রুটি বানানোর জন্য। প্রতিটি দোকানে আছে আখের গুড় ও ডাল। কাঠের টুলে বসে কেউ আখের গুড়, কেউ ডাল দিয়ে তন্দুরি রুটি খাচ্ছে। বেশ কিছু রুটি বানিয়ে মজুত করে রাখা হয়েছে। কেজি হিসেবে মেপে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিস হিসাবেও রুটি বিক্রি করতে দেখা যায়। তন্দুরি রুটির দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঠিক কত বছর আগে কে প্রথম বরমী বাজারে তন্দুরি রুটির দোকান দিয়েছিলেন, সেটা তাঁরা জানেন না। তবে এই হাটে তন্দুরি রুটির ব্যবসার বয়স যে অনেক, সে বিষয়ে সবাই একমত।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী হাট প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। এ হাট গাজীপুর অঞ্চলের বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ব্যবসা-বাণিজ্যর বাইরে বরমী হাটের গুরুত্ব তন্দুরি রুটির জন্য। এ হাটের একটি অংশে আছে সারি সারি তন্দুরি রুটির দোকান। স্থানীয় মানুষ এবং হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা আখের গুড়, জিলাপি আর ডাল দিয়ে এ রুটি খেয়ে চলেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

রুটির দোকানি মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন বরমী হাটে প্রায় ৩৫ বছর ধরে তন্দুরি রুটির দোকান করছেন। প্রতি বুধবার কলেজপড়ুয়া দুই ছেলে ইমরান আর রানা আহমেদকে নিয়ে আসেন দোকানে। আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি এই রুটির চাহিদা হাটবারে অনেক। হাটবার এলে রুটি বানিয়ে শেষ করা যায় না। প্রচুর লোকজন তন্দুরি রুটি খেতে দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে শত শত ব্যবসায়ী হাটেই খাওয়াদাওয়া করেন। তাঁদেরও প্রথম পছন্দ এই তন্দুরি রুটি।

বরমী বাজারের আর একজন তন্দুরি রুটি দোকানি বড়নল গ্রামের আজিজুল ইসলাম। কথা বলে জানা গেল, আজিজুল ২৫ বছর ধরে আছেন এই পেশায়। বাবার কাছ থেকে শিখে তন্দুরি রুটির ব্যবসায় পার করে দিয়েছেন দুই যুগের বেশি সময়। বেচাকেনা খুবই ভালো তাঁর দোকানে। বুধবার হলে তা আরও বাড়ে। এক বস্তা আটা বা ময়দা শেষ হয় এক দিনেই। পাশাপাশি ডাল আর গুড় তো আছেই।

কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রাম থেকে বরমী হাটে তন্দুরি রুটি খেতে এসেছেন শামীম হোসেন নামের এক যুবক। মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের রুটির দোকানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রুটি খেতে খেতে তিনি জানান, এটা আজ নতুন নয়। ছোটবেলা থেকে দাদা আজিম উদ্দিনের হাত ধরে রুটি খেতে বরমী বাজার আসতেন তিনি। এখন নিজেই চলে আসেন। খাওয়ার পাশাপাশি কিনে নিয়ে যান বাড়ির জন্য।

গফরগাঁও উপজেলার নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রামের শরিফ হোসেন বলেন, ‘নদীপথে বরমী বাজারে আসি ছোটবেলা থেকে। এখন সড়ক যোগাযোগ ভালো হয়েছে। বরমী বাজারে এসে তন্দুরি রুটি না খেয়ে ফিরলে কোনো কিছু যেন অসম্পূর্ণ থাকে। সপ্তাহের অন্তত বুধবার বরমী আসা হয়। এলেই তন্দুরি রুটির দোকানে হাজিরা দিতে যাই। লাল গুড় আর গরম-গরম রুটির স্বাদ দারুণ।’

বরমী বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বরমী বাজার যেমন ঐতিহাসিক, তন্দুরি রুটিও তেমনি প্রসিদ্ধ খাবার। এই রুটি খেতে আশপাশের বেশ কয়েক গ্রামের মানুষসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার অনেক মানুষ এখানে আসেন। রুটি না খেয়ে বরমী বাজার থেকে কেউ ফেরে বলে মনে হয় না।’ 

দরদাম
প্রতি কেজি তন্দুরি রুটির দাম ৮০ টাকা। তবে পিস হিসাবে কিনলে প্রতি পিসের দাম পড়বে ১০ টাকা। এর সঙ্গে ১০ টাকার গুড় কিংবা ডাল থাকে। জিলাপি পরিমাণমতো কিনে নিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত