Ajker Patrika

সর্বংসহা ফজিলাতুন নেছা মুজিব

ড. এম আবদুল আলীম
আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২২, ১১: ২৭
সর্বংসহা ফজিলাতুন নেছা মুজিব

কালে কালে এমন সব মানুষের আগমন ঘটে, যাঁরা সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো সবকিছু সহ্য করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং জীবন উৎসর্গ করে যান। তাঁরা ধূপকাঠির মতো নিজে নিঃশেষ হন, কিন্তু সৌরভ ছড়ান চারদিকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন এমনই একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবনের সব সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে সব সময় পাশে থেকেছেন, প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দী অবস্থায় নেতা-কর্মীদের পাশে থাকা, তাঁদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া এবং মনোবল ধরে রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন, নানাভাবে তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।

কেবল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বেলায়ই নয়; স্বজন এবং সন্তানদেরও আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। মায়ের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ রেহানা লিখেছেন: ‘আর আমার মা! তাঁর কথা ভাবি। কত অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল।...গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত তা হলো, ধৈর্য আর সাহস।’

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। জন্মের পরই পিতৃহারা হন। তখন বয়স মাত্র তিন বছর। পিতার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষা দেবেন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ফলে ফজিলাতুন নেছা মুজিব লালিত-পালিত হন দাদার স্নেহের ছায়ায়। নাতনির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তিনি অল্প বয়সেই তাঁকে বিয়ে দেন চাচাতো ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে। এরপর শাশুড়ির স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠেন। শৈশব থেকে তিনি হয়ে ওঠেন আত্মসচেতন এবং কর্তব্যপরায়ণ। স্বামীকে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সব সময় সাহস জুগিয়েছেন। স্বাধিকার-সংগ্রামের দিনগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে ইতিহাস তাঁকে গৌরবের আসন দান করেছে।

 ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হলে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ তথা সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ওই সময় গদিনশিন আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করতে সম্মত হন। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে ফজিলাতুন নেছা মুজিব প্যারোলে নয়, নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে যেতে বারণ করেন। তিনি বড় মেয়ে শেখ হাসিনা আর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে। তাঁদের হাতে চিরকুট দিলেন। তাতে লিখলেন, ‘জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে।’ সেদিন সামরিক জান্তা শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

ড. এম আবদুল আলীম১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। অনেকে অনেক পরামর্শ দিলেও বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন সহধর্মিণীর পরামর্শ। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায়, সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ তোমার দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নাই। এই মানুষগুলির জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’ বঙ্গবন্ধু এই পরামর্শ গ্রহণ করেই তাঁর মানুষকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

 এভাবে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়ে সংগ্রামের পথে প্রেরণা ও শক্তি-সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি ছাত্রনেতাদের আর্থিক সহযোগিতা যেমন করতেন, তেমনি তাঁদের কারামুক্ত করতে আইনি সহায়তাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান তাঁদের স্মৃতিকথায় বারবার তাঁর সেসব ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ছিলেন সংস্কৃতিসচেতন। দেশীয় খাবার, পোশাক, অলংকার; তথা বাঙালিয়ানায় জীবন-যাপন করতেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন ধৈর্যশীলা ও কর্তব্যপরায়ণা। সব পরিস্থিতি সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। হতাশ হননি বা ভেঙে পড়েননি।

কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন: ‘শেখ সাহেবের স্ত্রী পরম ধৈর্যশীলা এবং শেখ সাহেবের রাজনীতির প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন।...শেখ সাহেবের স্ত্রী বুদ্ধি হবার পর থেকেই তাঁর স্বামীর জীবনধারার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিতে পেরেছিলেন। কারণ, বিয়ে হয়েছিল শেখ সাহেবের সঙ্গে, যখন তিনি ছিলেন বালিকা। তাই বাল্যে, কৈশোরে এবং যৌবনে স্বামীর সকল কাজের মধ্যে নিজেকে অংশীদার করে ফেলেছিলেন।...শেখ সাহেবের স্ত্রী শেখ সাহেবের জেলে যাওয়া, নির্যাতিত হওয়া এবং জীবন বিপন্ন করাকে তাঁর কর্মসূচির অন্তর্গত বলে গ্রহণ করে কোনো দিন ভেঙ্গে পড়েননি।’

বঙ্গবন্ধুর সব কাজের সহচারী সর্বংসহা এই নারী জীবনে যেমন পাশে ছিলেন, মরণেও তেমনি সঙ্গী হয়েছেন। স্বামীর নির্মম মৃত্যুর খবর শুনে তিনি বাঁচার জন্য আকুতি জানাননি; বরং নির্ভয়ে বলেছেন, ‘আমাকেও মেরে ফেল।’ এই সাহসিকতাই জীবনে-মরণে তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। তাঁর সংগ্রামী জীবন, বঙ্গবন্ধুর পাশে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো কাজ করা—সবই ইতিহাসে মর্যাদার আসন লাভ করেছে। জন্মদিনে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদোন্নতি দিয়ে ৬৫ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা: ডিজি

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

সমালোচনার মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের নিয়োগ বাতিল

মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত