Ajker Patrika

পয়লা বৈশাখ স্মৃতি হিরণ্ময়

সেলিম জাহান
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৯: ৫৭
Thumbnail image

পয়লা বৈশাখ এলেই বাংলাদেশের আনাচকানাচে রং আর রেখায় ভরে যায়। রং উঠে আসে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নেয় আলপনায়, দেয়ালে, প্রতিচিত্রে।

চারুকলার ছেলে-মেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা আঁকে, দেয়ালচিত্র শেষ করে, নানান রঙের আর ঢঙের মুখোশ বানায়, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়ে পয়লা বৈশাখ প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। কী উন্মাদনা, কী উৎসাহ চারদিকে—আনন্দ, ফুর্তি আর উৎসবের আমেজ আকাশে-বাতাসে।

নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয় প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। সব শহরের মতো ঢাকা শহরেও মেলা বসে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসে আকাশ-বাতাস।

কিন্তু এই সব চালচিত্র পেরিয়ে মন কখন যেন চলে যায় অনেক দূরে, প্রায় ৬৫ বছর আগে। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগই ছিল লাল সুরকির।ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ওই পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখারসহ আরও কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত।

কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে এবং সেটা ওই পয়লা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরে ওই পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সেই জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশু, মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে-পায়ে যে মনুষ্য ধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।

বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা, পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুলদানা কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।

মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল—ঘোড়া, বর-বউ, গরু, হাতি, পাখি—কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই! পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ওই সব পুতুলের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দুই হাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নিই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক! তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাঁদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।

বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ওই সব পুতুলের বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।

সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা—হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন মাখন কাকা আর হারাধন জ্যাঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান চিটাগং বস্ত্রালয়ে, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণির মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যত দূর মনে পড়ে, বাবা একটা টাকা প্রতীকী হিসেবে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন।

সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাঁদের কর্মচারীদের গরম-গরম রসাল মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা-ওটা খাওয়ার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন, যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাওয়া শেষে পিতলের ঘটি-গেলাশে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণির মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।

কিন্তু সব সময় যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ওই হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকাপয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পিতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত, হিসাব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ওই লাল খাতাটির ওপরে হাত বুলোতাম। লালসালুর ওই খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।

তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা তাঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে, তার আভায় সিঁদুররাঙা সিঁথি আর জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’

আমি তাঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুমচোখে দেখেছি, তাঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপারের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এপারের ঘাটে।

আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কী রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপুজো সেরে এলি?’ আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ওই আশীর্বাদ, ওই মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে—শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত