Ajker Patrika

লোভের জাল গ্রামে গ্রামে

সাইফুল মাসুম, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর থেকে ফিরে
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ৩৫
লোভের জাল গ্রামে গ্রামে

‘গ্রামের মাঠগুলো খালি পড়ে থাকে। অনেক তরুণ ইতালি চলে গেছে। কেউ কেউ লিবিয়া ও মাল্টায় বন্দী। আমার ভাই মিরাজও চার মাস আগে লিবিয়া গেছে। এখন ভূমধ্যসাগরে “গেম” দেওয়ার অপেক্ষায়।’ এই মন্তব্য মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের ওয়ালিয়ুর রহমানের। মঙ্গলবার থেকে চার দিন মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেল, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপযাত্রাকে স্থানীয় মানুষ গেম বলে। স্থানীয় তরুণদের ইউরোপযাত্রার স্বপ্নের সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা। দালালেরা প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে তরুণদের প্রলুব্ধ করে ইতালি যেতে। দুই জেলার কয়েক হাজার তরুণ প্রতিবছর অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকে লিবিয়ায় আটকা।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার সব ধরনের অবৈধ ও অনিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনকে সব সময় নিরুৎসাহিত করে। বিদেশে হয়রানির শিকার হলে লেবার ওয়েলফেয়ার উইংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ অব্যাহত আছে।’ দক্ষ হয়ে জেনে-বুঝে বিদেশে পা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

‘গেমে’ অংশ নেওয়ার স্বপ্ন
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নন্দনসার গ্রামের নাসির মিয়া বলেন, তিনি ২০১৯ সালে মনির দালালকে চার লাখ টাকা দিয়ে দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে গেমে অংশ নিতে দিতে হয় দুই লাখ টাকা। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ধরা পড়েন মাল্টার নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে। ২৭ মাস জেল খেটে দেশে ফেরেন।

মাদারীপুর-শরীয়তপুরের তরুণদের অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া শুরু নব্বইয়ের দশকে। সেখানে গিয়ে ভাগ্যও বদলেছে কারও কারও। ফলে এলাকার কিশোর-তরুণদের স্বপ্ন, ‘গেমে’ অংশ নিয়ে ইতালি যাওয়া। মাদারীপুরের অনেক গ্রাম তরুণশূন্য। অনেকে লিবিয়ায় পাচারকারীদের নির্যাতন সইছেন। ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের।

ব্র্যাকের তথ্যমতে, ২০২২ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছেন ২২ হাজার ১০৫ বাংলাদেশি। ভূমধ্যসাগরে বছরে মৃত্যু হয় অন্তত ৫০০ বাংলাদেশির।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসব জেলায় মানব পাচার বেশি, সেখানকার পরিবারগুলো সচেতন না হলে এটা ঠেকানোর উপায় নেই।’

পথে পথে দালাল, পদে পদে টাকা 
ভূমধ্যসাগর দিয়ে মানব পাচারে দেশে সক্রিয় দুই শতাধিক দালালের বড় অংশের বাড়ি মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে। তাদের বাইরেও গ্রামে ছড়িয়ে আছে ছোট অনেক দালাল। তারা আগ্রহী তরুণদের সন্ধান দেয়। তরুণদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখায়। চুক্তির টাকার ১০-২০ শতাংশ পায় স্থানীয় দালাল।

লিবিয়াফেরত একাধিক বাংলাদেশি জানান, সব জায়গায় দালাল চক্রের সদস্যরা থাকে। ‘মামা-ভাগিনা’, ‘ভাবীর লোক’ ইত্যাদি শিখিয়ে দেওয়া কোড তাদের কাছে বলতে হয়। লিবিয়ায় মাসের পর মাস থাকতে হয় অন্য দালালের জিম্মায়। তখন আরও টাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়। লিবিয়া থেকে ফিরে আসা রাজৈর উপজেলার মজুমদারকান্দি গ্রামের সাব্বির আহমেদ আরমান (২২) জানান, আট লাখ টাকায় ইতালি পৌঁছানোর চুক্তিতে পাশের এলাকার ইলিয়াস মীরের মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। লিবিয়ায় দায়িত্ব নেয় ইলিয়াসের ভাই আলী মীর। লিবিয়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে আলী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে। লিবিয়ায় সাব্বিরকে অমানবিক নির্যাতন সইতে হয়েছে। ঠিকমতো খাবার পাননি, প্রস্রাব করতে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। কথায় কথায় রডের আঘাতের ক্ষতচিহ্ন এখনো হাতে-পায়ে। সাব্বির বলেন, ‘আমাদের মূলত লিবিয়া নিয়া আটকাইছে। আলী মীরের কাছে বিক্রি হয়া গেছি, এটা জানতাম না। পরে আলী মীর বিক্রি করেছে শওকত আকন্দর কাছে।’ এভাবে সাব্বিরের পরিবারকে গুনতে হয়েছে ২২ লাখ টাকা।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘অভিবাসনপ্রত্যাশীরা মনে করে, কোনোরকমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে পারলেই হবে। যাওয়ার পথে তারা দালালদের হাতে নিগ্রহের শিকার হয়।’

দালালেরাও লুকিয়ে
রাজৈরের দুর্গাবর্দি গ্রামে দালাল ইলিয়াস মীরের খোঁজ নিতে গিয়ে ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাদারীপুর-শরীয়তপুরের অধিকাংশ দালালের ঘর তালাবদ্ধ থাকে। মাদারীপুর সদর উপজেলার তালতলা বাজারসংলগ্ন দালাল সোহাগ মুন্সীর বাড়িতে গিয়েও ঘর তালাবদ্ধ দেখা যায়। ইতালি যাওয়ার বিষয়ে কথা বললে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সোহাগের মা লুৎফুন নেছা। তিনি বলেন, ‘লোকজন টাকার জন্য চাপ দেয়।’ জানা যায়, সোহাগের মাধ্যমে শতাধিক মানুষ লিবিয়ায় গেছেন। এখনো অনেকে জিম্মি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে মাদারীপুরের কিছু দালালের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে আছে সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ির জামাল খাঁ ও রুবেল খাঁ, শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, কুমড়াখালীর এমদাদ ব্যাপারী, চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, নয়াচর গ্রামের মহসিন মাতুব্বর ও মিজান মাতুব্বর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার; রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুরের জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ির রবিউল, শাখারপাড়ের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের শামীম ফকির, সম্রাট ফকির; শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতুব্বর, সিরাজ মাতুব্বর প্রমুখ। শরীয়তপুরের অর্ধশত দালালের নাম জানা গেলেও যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘মানব পাচারে যুক্ত দালালদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে অপরাধ কমে আসত।’

 দেনায় নিঃস্ব পরিবার
রাজৈরের কৃষ্টপুর গ্রামের মাহবুব শেখ বছরখানেক আগে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়। দুবার ধরা পড়েন লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের হাতে। মাহবুবের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সুলতান বলেন, ‘বদরপাশার মিলন দালালের মাধ্যমে ছেলে গেছে লিবিয়ায়। চুক্তি ছিল ১০ লাখ টাকায় পৌঁছে দেবে ইতালি। দালাল বিভিন্ন অজুহাতে নিয়েছে ৩২ লাখ টাকা। এই টাকা সংগ্রহ করেছি জমি বেচে, বাড়ি বন্ধক রেখে, সুদে ঋণ নিয়ে। এখন আবার গেমে যাওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা পাঠাতে কান্নাকাটি করছে ছেলে।’

বদরপাশার রশিদ ব্যাপারী দুই বছর আগে ইলিয়াসের মাধ্যমে লিবিয়ায় যান। সেখানে দালাল আরও টাকা দাবি করে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ধরা পড়েন রশিদ। সেখান থেকে ছাড়িয়ে আবার ১০ লাখ টাকা চায় দালালেরা। রশিদকে নির্যাতন করে সেই ভিডিও পাঠানো হয় পরিবারের কাছে। মা শরবতি বেগম বসতভিটা বেচে টাকা দেন দালালকে।

খোকন মোল্লার মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে তিন বছর ধরে জিম্মি মাদারীপুর সদরের পেয়ারপুর গ্রামের রাশেদ মাতাব্বর। দুবার ভূমধ্যসাগরে ধরা পড়েন। এরপর হাতবদল হয়ে যান মিরাজ ও রিপনের কাছে। তারা নিয়েছে ১৬ লাখ টাকা। আরও ৪ লাখ টাকা চাইছে। রাশেদের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমরা চাই, আল্লাহ যেন ইতালি পার করে। অনেক টাকা ঋণ হইছি। দেশে আসলে তো আর দেনা দিতে পারব না।’

আইনের আশ্রয় নিতেও ভয়
মানব পাচারে নির্যাতন, হয়রানি, মৃত্যুর ১০ শতাংশ ঘটনা সামনে আসে। ব্র্যাকের তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে মামলা হয়েছে ৬ হাজার ৫২০টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৭২৮টি। ৫০টি মামলায় ৯৬ জনের সাজা হয়েছে। নিষ্পত্তির হার ১১ শতাংশ। সাজা ২ শতাংশের কম।

সিআইডির বিশেষ সুপার নজরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে অনেক ভুক্তভোগী থাকায় মানব পাচারের মামলাও বেশি।’

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘ব্যক্তি স্বেচ্ছায় অবৈধ পথে বিদেশ যেতে চায়। বিপদে পড়লে আইনের কাছে আসে। অনেক মামলা আপসে নিষ্পত্তি করে নেয়।’ তিনি জানান, ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই বছরে জেলায় ৭৯টি মামলা হয়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৩৫টির। ৩৫৩ আসামির মধ্যে ৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল হক জানান, দুই বছরে ৩২টি মামলা হয়েছে। অভিযোগপত্র হয়েছে ৪টির। ৪১ আসামির ১৬ জন গ্রেপ্তার।

ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবার জানায়, সন্তানদের ক্ষতি হয় কি না, সেই ভয়ে তাঁরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অনেকে মামলা করে না। মানুষের সচেতনতা বাড়াতে সরকারকে কাজ করতে হবে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আয়শা সিদ্দিকা আকাশী (মাদারীপুর) ও সজীব ফরাজী (রাজৈর)।]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আ. লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তারাই সিদ্ধান্ত নেবে: বিবিসিকে প্রধান উপদেষ্টা

‘মবের হাত থেকে বাঁচাতে’ পলকের বাড়ি হয়ে গেল অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

স্বাধীনতা পদক পাচ্ছেন এম এ জি ওসমানীসহ ৮ জন

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত