Ajker Patrika

অনভ্যস্ত দুর্যোগে মানসিক আঘাত

  • কারও কারও ক্ষেত্রে আঘাত কাটতে সময় লাগতে পারে
  • কাউন্সেলিংসহ মানসিক সহায়তা প্রয়োজন
  • মহড়ার ব্যবস্থা থাকলে মানসিক আঘাত কমাতে সহায়ক হবে
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ০০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

গত শুক্রবার সকালে ছুটির দিনের আমেজটি ভেঙে খান খান করে দিয়েছে সারা দেশ কাঁপিয়ে তোলা ভূমিকম্প। অগুনতি মানুষ নিশ্চয়ই নানা পারিবারিক বা বিশেষ সামাজিক আয়োজনে দিনটি কাটাবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। পায়ের নিচে পৃথিবী পাগলের মতো দুলে উঠে মুহূর্তেই ছড়িয়ে দিল আতঙ্ক। অবকাঠামো ভেঙে প্রাণও হারাল শিশুসহ কয়েকজন। উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে বা হুড়োহুড়ি করে ঘর ছাড়তে গিয়ে আহত হয়েছে আতঙ্কিত অনেক মানুষ।

ভূমিকম্পের পরও বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। পারস্পরিক আলাপ ছাড়াও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তার নমুনা। ভূমিকম্পের প্রবল কম্পনে অনেকেই তীব্র মানসিক আঘাত পেয়েছে। ঘটনার এক দিন পর গতকাল শনিবারও অনেকে স্বাভাবিক হতে পারেনি। গতকালই আবার সকাল-সন্ধ্যা দুই দফা মৃদু পরাঘাত অনুভূত হওয়ায় তাদের অস্বস্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে অপরিচিত দুর্যোগ হওয়ায় এতে মানসিক আঘাতের প্রভাব বেশি। ভূমিকম্পের গাণিতিক মাত্রার তুলনায় কম্পনটা অনেক বেশি অনুভূত হওয়ায় সবার মনে তা বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।

রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের (ইউএসজিএসের হিসাবে ৫.৫) দুলুনি শুরু হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে থাকা মানুষ সাধ্যমতো দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে। খোলা জায়গা সীমিত যেসব জায়গায়, সেখানে আবার ভয় ছিল মাথার ওপর আশপাশ থেকে কিছু ভেঙে পড়ে কি না। ওপরের তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে নানা মাত্রায় আহত হয়েছে কয়েক শ মানুষ। শুক্রবার রাত ৮টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হয়েছিল, ভূমিকম্পে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ৬০৬ জন আহত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা নেয় আরও অনেকে। কিছু রোগী ভর্তিও রয়েছে।

হাত-পা ভাঙা বা মচকানোর মতো দৃশ্যমান শারীরিক আঘাতের ধকল সামলানো গেলেও বিশেষজ্ঞদের এখন ভাবাচ্ছে মানসিক আঘাতের বিষয়টি। গতকালও অনেকেই মানসিক ধাক্কার আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী আতাউর রহমান জানান, তিনি একটি ১০ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় থাকেন। ভূমিকম্প শুরু হতেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিচে নেমে যান।

আতাউর রহমান বলেন, ‘ওই রাতে ঘুমাতে গেলে মনে হয় খাট দুলছে। চোখ খুললেও মনে হয় পুরো ঘর যেন কাঁপছে। সারা রাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি। সকালে ওঠার পরও শরীর দুর্বল, মাথা ঘোরে, চারপাশ দুলছে মনে হয়। পরিবারের আরও কয়েকজনের কমবেশি একই অবস্থা। ওদের সাহস দিতে নিজের ভয় লুকিয়ে রেখেছি।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্প খুব ঘন ঘন না ঘটায় মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে স্বাভাবিক প্রস্তুতি বা ঝুঁকিবোধও তুলনামূলক কম। শুক্রবারের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। অনেকের মতে, কয়েক দশকের মধ্যে দেশে কোনো ভূমিকম্প এত শক্তিশালীভাবে অনুভূত হয়নি। আবার এর উৎপত্তিস্থল দেশের অভ্যন্তরে, রাজধানীর অদূরে। সব মিলিয়ে এই ‘অপরিচিত দুর্যোগ’ মানুষের মনে আচমকা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এমন অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক দুর্যোগ মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত ভীতি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। কারও কারও ক্ষেত্রে এই মানসিক আঘাত কাটতে সময় লাগতে পারে।

দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন—এমন কয়েকজন চিকিৎসক আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এ ধরনের দুর্যোগে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, মৃত্যুভীতি ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর অনুভূতি সৃষ্টি হয়। শিশু, বৃদ্ধ, একা থাকা বা পূর্বে আঘাতের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব তীব্র হয়। এদের ট্রমা কাউন্সেলিংসহ মানসিক সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের সময় পুরো ভবন কেঁপে ওঠা, সবার দ্রুত পালানোর চেষ্টা, চারপাশের বিশৃঙ্খলা এবং পরে সম্ভাব্য পরাঘাতের আশঙ্কা—এসব মিলিয়ে একটি তীব্র মানসিক অভিঘাত সৃষ্টি হয়। এই অভিঘাত অনেক সময় সাধারণ আতঙ্কের বাইরে গিয়ে অ্যাংজাইটি (গভীর উদ্বেগ), প্যানিক অ্যাটাক, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি), ঘুমের ব্যাঘাত, মাথাঘোরা বা দুলুনি অনুভবের মতো লক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব ফেলে। অনেকের প্যানিক অ্যাটাক বা ঘুমের ব্যাঘাত হয় এবং সারাক্ষণ ভয় বা আতঙ্কে দিন কাটে, যা স্বাভাবিক। এটা কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় হলো স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং সেই সময় ঘটে যাওয়া ইতিবাচক বিষয়গুলো মনে রাখা। নেতিবাচক স্মৃতিগুলো এড়িয়ে চলা জরুরি। যাঁদের মানসিক আঘাত বেশি, তারা অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’

ভূমিকম্পের পর মানসিক আঘাতের প্রমাণ বহু গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী বায়োমেড সেন্টারের বিএমসি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৪০টি প্রাসঙ্গিক গবেষণায় ভূমিকম্প-পরবর্তী পৌনে এক লাখ বেঁচে থাকা ব্যক্তির তথ্য পরীক্ষা করে প্রায় ১৮ হাজারের মধ্যে পিটিএসডি নির্ণয় করা হয়েছে।

তুরস্কের ২০২৩ সালের ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উপদ্রুত এলাকার মানুষের মানসিক আঘাত নিয়ে একটি গবেষণা গত জুলাইতে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে। ওই ঘটনার এক বছর পরও স্থানীয় মানুষের মধ্যে মানসিক আঘাত দেখা গেছে গবেষণায়। দেখা গেছে, গবেষণায় অংশগ্রহণ করা আড়াই হাজার ব্যক্তির অর্ধেকের মধ্যেই উচ্চমাত্রার মানসিক ট্রমা ছিল। ৬০ শতাংশের মধ্যে উচ্চমাত্রার পোস্ট-ট্রমাটিক উপসর্গ, ৪৪ শতাংশের মধ্যে উচ্চ উদ্বেগ এবং ৬১ শতাংশের মধ্যে উচ্চ বিষণ্নতার উপসর্গ ছিল। ৩৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে তিনটি উপসর্গই লক্ষ করা গেছে।

জাপান, চীন, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পের পর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চালানো আরও অনেক গবেষণাতেই প্রায় একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক আঘাত একসময় উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, যা ডায়াবেটিসকে প্রভাবিত করতে পারে। পরে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। কিডনির সমস্যাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভূমিকম্প কখন হবে, তা আগে থেকে জানা সম্ভব হয় না। এতে প্রথম অবস্থায় অবকাঠামো ধ্বংস হয় এবং মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাণহানি ঘটে। তবে তাৎক্ষণিক এই শারীরিক-মানসিক আঘাতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাবও থাকে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, প্রিয়জন হারানো ও সম্পদ বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কাসহ নানা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যার মধ্যে অনিদ্রা, পিটিএসডি ও উদ্বেগ অন্তর্ভুক্ত।’

লেলিন চৌধুরী সরকারি কর্তৃপক্ষকে ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগের সময় কী করতে হবে, তা মহড়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শেখানোর পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, এতে মানুষ মাথা ঠান্ডা রেখে বিপদের সময় সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে। তাতে মানসিক আঘাতের আশঙ্কা কমবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঢাকায় ভূমিকম্পের গভীরতা ১০ কিলোমিটার কেন

মহাখালীতে চলন্ত বাসে দেওয়া হয় আগুন, হুড়োহুড়ি করে নেমে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

ভূমিকম্প আতঙ্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, হল ছাড়ার নির্দেশ

বিমানবন্দরে দুই কোটি টাকার স্বর্ণসহ হজের মুয়াল্লিম গ্রেপ্তার

ট্রাম্প-মামদানির বৈঠকের পর ভারতের জন্য যে বার্তা দিলেন শশী থারুর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ