Ajker Patrika

ভারত থেকে আসা দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে অতিষ্ঠ বাংলাদেশের গ্রাম

অনলাইন ডেস্ক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আবদুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের ক্লাস শুরু হয় পাশের ‘কাটাখাল’ থেকে আসা বর্জ্য পদার্থের দুর্গন্ধ নিয়ে। ছবি: মঙ্গাবে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আবদুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের ক্লাস শুরু হয় পাশের ‘কাটাখাল’ থেকে আসা বর্জ্য পদার্থের দুর্গন্ধ নিয়ে। ছবি: মঙ্গাবে

প্রতিদিন সকালে দুর্গন্ধ নিয়ে ক্লাস শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আবদুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ের পাশেই বয়ে চলেছে দুর্গন্ধময় কালো পানিভর্তি ‘কাটাখাল’ নামের একটি খাল, যার উৎস ভারতের আগরতলা শহর। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে আসা ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের প্রায় আট কিলোমিটার বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে তিতাস নদীতে। এই খালের একটি অংশকে বলা হয় আখাউড়া চ্যানেল।

বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাহমুদা আখতার বলেন, ‘এই খালের পানির দুর্গন্ধের কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষকেরা সব সময় সতর্ক থাকেন, যেন কোনো শিশু খালের ধারে না যায়।’ মার্কিন পরিবেশবিষয়ক গবেষণাধর্মী ওয়েবসাইট মঙ্গাবের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রায় সারা বছরই খালে কালো পানি প্রবাহিত হয়। স্থানীয় কৃষক জান মিয়া ও নজরুল ইসলাম জানান, তাঁরা কখনো এই খালের পানি পরিষ্কার দেখেননি। বিশেষ করে, শুষ্ক মৌসুমে পানির অবস্থা আরও খারাপ হয়।

বলা হয়, ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরার রাজারা এই খাল বানিয়েছিলেন পণ্য পরিবহনের জন্য। তবে দেশভাগের পর বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, আর খালটি ধীরে ধীরে আগরতলার পৌর ও শিল্প বর্জ্যের নিষ্কাশনপথে পরিণত হয়। বাংলাদেশ সরকার বহুবার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত আলোচনায় এই খালের দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত বছর আগরতলার আখাউড়া রোড এলাকায় একটি বর্জ্য (দৈনিক ৮ মিলিয়ন লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন) শোধনাগার চালুর খবর কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও বাস্তবে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।

৫৩ বছর বয়সী মনু মিয়া মনে করেন, কাটাখালের দূষিত পানি তাঁদের ফসলের ওপর তেমন কোনো খারাপ প্রভাব ফেলে না। ছবি: মঙ্গাবে
৫৩ বছর বয়সী মনু মিয়া মনে করেন, কাটাখালের দূষিত পানি তাঁদের ফসলের ওপর তেমন কোনো খারাপ প্রভাব ফেলে না। ছবি: মঙ্গাবে

বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিতভাবে কাটাখাল ও তিতাস নদীর পানির মান পরীক্ষা করে। সর্বশেষ এপ্রিল মাসের পরীক্ষায় দেখা যায়, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা অনুমোদিত ৫ মিলিগ্রাম/লিটারের নিচে, আর বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন চাহিদা ও কেমিক্যাল অক্সিজেন চাহিদা যথাক্রমে ৩০ ও ৫০ মিলিগ্রাম/লিটার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রামের পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করা এই পানির নমুনা ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।

আখাউড়ার প্রায় ১ হাজার ২০০ একর জমিতে কৃষিকাজ হয়, যার বেশির ভাগই দুই ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে বিকল্প পানির অভাবে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে কাটাখালের দূষিত পানি ব্যবহার করছেন। ৩৩ বছরের কৃষক জাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘এই পানি ব্যবহার করলে গায়ে চুলকানি হয়, কিন্তু বিকল্প না থাকায় এই পানিই ব্যবহার করি।’ ৫৩ বছর বয়সী মনু মিয়াও একই কথা বলেন। যদিও তাঁদের ধারণা, এই পানি ফসলের ওপর তেমন কোনো খারাপ প্রভাব ফেলে না।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। আগের কিছু পরীক্ষায় কাটাখালের পানিতে ক্যাডমিয়াম, সালফার, সিসা, ম্যাঙ্গানিজ ও ক্রোমিয়ামের মতো ক্ষতিকর ভারী ধাতু পাওয়া গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘এই দূষিত পানি ব্যবহারে ধীরে ধীরে মাটি ও ফসলের মধ্যে বিষাক্ত উপাদান জমা হয়, যা মানবদেহে পৌঁছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।’

আখাউড়ার গরুচাষিরা কাটাখালের কচুরিপানাকেই পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। ছবি: মঙ্গাবে
আখাউড়ার গরুচাষিরা কাটাখালের কচুরিপানাকেই পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। ছবি: মঙ্গাবে

২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই দূষিত পানিতে জন্মানো জলজ উদ্ভিদ, যেমন কচুরিপানা দুধ ও মাংসে সিসা ও দস্তার মতো ধাতু জমা করে। কিন্তু আখাউড়ার গরুচাষিরা কাটাখালের কচুরিপানাকেই পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে পশুর স্বাস্থ্য ও পরোক্ষভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আখাউড়ায় প্রতিদিনই কাটাখালসংলগ্ন এলাকা থেকে চর্মরোগে আক্রান্ত রোগী আসে বলে জানান আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিমেল খান। তাঁর মতে, চিকিৎসা দিলেও অনেক রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয় না।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই ১৯৯২ সালের জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন-সম্পর্কিত রিও ঘোষণার স্বাক্ষরকারী, যেখানে বলা হয়েছে, কোনো দেশ তার সীমান্তবর্তী দেশকে পরিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।

ভারতের ত্রিপুরা সরকার কাটাখাল ও কালাপানিয়া খাল থেকে আসা বর্জ্য শোধনের জন্য মোট ৩১.৫ মিলিয়ন লিটার দৈনিক ক্ষমতার চারটি বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করছে। কাজটি মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, তবে এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘উভয় দেশের যৌথ নদী কমিশনের অধীনে আমরা এই সমস্যা সমাধানে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা আমাদের পক্ষেও একটি বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যত দিন না সীমান্তের ওপার থেকে দূষণ বন্ধ হচ্ছে, তত দিন আমাদের জনগণকে রক্ষা করতেই এ পদক্ষেপ জরুরি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘অপারেশন সিঁদুরে’ তিন শত্রুর মোকাবিলা করেছে ভারত, অন্য দেশের নাম জানালেন সেনা কর্মকর্তা

যুবলীগ নেতাকে ধরতে নয়, বাসাটি ঘেরাওয়ের নেপথ্যে অন্য কারণ

‘একটা মার্ডার করেছি, আরও ১০০টা মার্ডার করব’, ভিডিও ভাইরাল

মহাকাশে হারিয়ে গেল ৯ কোটি ডলারের স্যাটেলাইট, জলবায়ু গবেষণায় বড় ধাক্কা

ভুল করার পর জাদেজাকে কী বলে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশের আম্পায়ার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত