Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

সুযোগ থাকলে ‘পদাতিক’ যেন দেশের হলে মুক্তি দেওয়া হয়

ছবি: সংগৃহীত

সৃজিত মুখার্জির পরিচালনায় ‘পদাতিক’ সিনেমায় কিংবদন্তি নির্মাতা মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। গত বছর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একই দিনে মুক্তির কথা ছিল সিনেমাটির। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। অবশেষে ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে পদাতিক দেখার সুযোগ পেয়েছেন দেশের দর্শক। পদাতিক ও অন্যান্য প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন শিহাব আহমেদ।

ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলো ‘পদাতিক’। এবারই প্রথম দেশের দর্শক সিনেমাটি দেখার সুযোগ পেল। উৎসবে অনেকেই আপনার উপস্থিতি আশা করছিলেন। আপনি ছিলেন না কেন?

ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবেই প্রথমবার বাংলাদেশে সিনেমাটি দেখানো হলো। আমার খুব ভালো লাগছে কিছু দর্শক পদাতিক দেখার সুযোগ পেয়েছে। উৎসবে আমি থাকতে পারলে আরও ভালো লাগত। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা ছিল, এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় ছিল। যেকোনো কারণেই হোক, যাওয়া হয়নি। পদাতিকের শোয়ের পর অনেকেই আমাকে মেসেজ দিয়েছেন, ফোন করে ভালো লাগার কথা বলছেন; এটা আমাকে আপ্লুত করেছে। পদাতিকে কাজ করার সময়ও আমার এমন আগ্রহ ও উত্তেজনা ছিল। মৃণাল সেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকের চরিত্রে অভিনয় করব, এটা চিন্তা করতেই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছিল। ভারতবর্ষে লাখ লাখ অভিনেতা আছেন। অনেকেই মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মুখিয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই সৌভাগ্যটা আমার হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেও একই দিনে পদাতিক মুক্তির কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ভবিষ্যতে কি মুক্তির কোনো সম্ভাবনা আছে?

রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে রিলিজ করা যায়নি। প্রযোজক ফেরদৌসুল হাসান সবকিছু চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। এটা আমার জন্য খুব বড় আফসোস। রিলিজের সময় কলকাতায়ও যাইনি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে। আমি খুব করে চাইব, সুযোগ থাকলে সিনেমাটি যেন এ দেশের হলে মুক্তি দেওয়া হয়। চলচ্চিত্র উৎসবে তো সবাই দেখতে পারে না। সিনেমা হলে রিলিজ হলে সাধারণ দর্শকেরা দেখার সুযোগ পাবেন।

পদাতিকের শুটিংয়ের আগে আপনার বাবা মারা যান। সেই শোক নিয়েই মৃণাল সেন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে। কেমন ছিল সেই দিনগুলো?

যে দুঃসময়ে কাজটি করেছি, সেটা ভাবলে এখনো শিউরে উঠি। বাংলাদেশের একজন অভিনেতা হিসেবে কিংবদন্তি মৃণাল সেনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারব কি না, এটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লুক সেটের সময় আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর শুটিংয়ে যাওয়ার আগে তিনি মারা গেলেন। সেই অবস্থায় আমার ভেতরে যে কী চলছিল, সেটা শুধু আমিই জানি। শুটিংয়ে যাওয়ার পর সৃজিত মুখার্জি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আপনার বিষয়ে একটা কথা জানি, আপনি যখন একটা চরিত্রে ঢোকেন, সেটা শেষ না করা পর্যন্ত চরিত্র থেকে বের হন না। আমি বুঝতে পারছি মানসিকভাবে খুব ডিস্টার্বড। তবে যখন আপনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন, যতটুকু শট দেবেন; ওই সময়টুকু শুধু ক্যারেক্টারে থাকবেন। বাকি সময় আপনি আপনার মতো করে থাকেন।’ এই সাপোর্ট উনি আমাকে দিয়েছিলেন। সে সময় এমন কোনো রাত ছিল না, যে রাত দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত শুটিং করে আসার পর পরের দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছি আর চিৎকার করে হোটেল রুমে কাঁদছি। যত দিন পদাতিকের শুটিং করেছি, এটা ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিনের মতো। তখন তো একেবারে দগদগে শোক। ওই কষ্ট পার করে কাজটা করা আমার জন্য বড় স্ট্রাগল ছিল।

আপনি দেখেছেন পদাতিক?

লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখেছিলাম। সেখানে তিনটা শো হয়েছিল। তবে ওই সময় সিনেমাটি ঠিকমতো দেখা হয়নি, নিজের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, ব্যক্তিগত ইমোশনের কারণে আমি কি ক্যারেক্টার থেকে বের হয়ে গেছি? কোনো এক্সপ্রেশনে কি মনে হচ্ছে যে আমি মৃণাল সেন নই? নাকি চোখমুখে ফুটে উঠেছে আমার শোক? অভিনয় করতে গিয়ে মৃণাল সেনের বাইরে অন্য কোনো চরিত্র হয়ে গেছে কি? তিনটি প্রদর্শনীতে শুধু এসবই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। আমি জানি না দর্শক দেখার সময় এই বিষয়টি বুঝতে পারবে কি না। ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে গিয়ে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা যেকোনো শিল্পীর জন্য চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে টানাপোড়েন থাকে, চড়াই-উতরাই থাকে। কিন্তু যখন আমরা কোনো চরিত্রে অভিনয় করি, তখন সারা পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। কোনো কিছুই যেন বাধা হয়ে উঠতে না পারে, সেই চরিত্রটি ধারণের জন্য।

আপনিসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পী টালিউডে কাজ করেছেন। কিন্তু এখন ভিসা জটিলতাসহ অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কি এই সংস্কৃতি বিনিময়ে বাধাগ্রস্ত হবে?

শুধু আমি নই, অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। সবাই দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। আমরা শুধু দুই বাংলা না, পুরো পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য কাজ করছি। সেই জায়গা থেকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য কিছুটা হলেও সংস্কৃতির বিনিময়গুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, রাজনৈতিক বাধা যতই আসুক, শিল্পের আলাদা একটা শক্তি আছে। যারা শিল্পপ্রেমী, তাদেরকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো নোংরা রাজনীতি দিয়ে গান শোনা বন্ধ করা যাবে না, সিনেমা দেখা বন্ধ করা যাবে না। আমাদের শিল্পী, নির্মাতারা যাঁর যাঁর মতো করে একটা দর্শকশ্রেণি তৈরি করেছেন। সেই দর্শককে কোনোভাবেই কোনো নোংরা রাজনীতির ফাঁদে ফেলে আটকানো যাবে না। এটাই হচ্ছে শিল্পের শক্তি। সাময়িক সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত তো একটু হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে এটা কমবেশি হবেই। এটার আঁচ শিল্পসাহিত্য থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই লাগে। সেখান থেকে আবার আমাদের মুক্ত হয়ে স্বকীয় জায়গায় ফিরে আসতে হবে।

৩০ জানুয়ারি আপনার অভিনীত নতুন সিরিজ ‘ফেউ’ মুক্তি পাচ্ছে...

একটা জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার লড়াই নিয়ে তৈরি হয়েছে সিরিজটি। এটি সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হলেও গল্পটি খুব বেশি মানুষ জানে না। এবার সিরিজের মাধ্যমে সেই গল্পটি অনেকেই জানার সুযোগ পাবেন। একটা জনগোষ্ঠীর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়া, তাদের জীবনের সংকট, জীবন-মরণ—সবকিছু মিলিয়ে অনবদ্য একটা গল্প। নির্মাতার কাছ থেকে প্রথম যখন গল্পটি শুনি, তখন খুব চিন্তায় ছিলাম কীভাবে সে পর্দায় দেখাবে। সেই কঠিন কাজটি খুব ভালোভাবেই শেষ করতে পেরেছেন নির্মাতা। এখন দর্শক কাজটি কীভাবে গ্রহণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।

ওটিটি আসার পর আমাদের নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে এই মাধ্যমেও বিষয়ের বৈচিত্র্য তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার কী মন্তব্য?

আমরা একই ধরনের গল্পের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, এটা হয়তো সত্যি। নতুন নতুন গল্প নিয়ে কাজ করলে দর্শকের আগ্রহ বেশি থাকে। যখন নতুন ভাবনা দিয়ে দর্শকদের চমকে দেওয়া যায়, তখনই তারা কাজটি দেখে। দর্শক সব সময় আমাদের কাছে ভালো কাজ চায়। ভালো কাজের অর্থ এমন নয় যে একটি কাজ সবাই পছন্দ করল, সেটাকে পুঁজি করে সেই ধরনের কাজ বারবার করলাম। যাঁরা নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আছেন, যাঁরা পরিচালনা করেন, অভিনয় করেন; তাঁদের অনেক দায়িত্ব। আমাদের প্রচুর গল্প আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাখ লাখ গল্প ছড়িয়ে আছে। যাঁরা নতুন গল্প ও ভাবনা নিয়ে কাজ করবেন এবং সেটা যদি রিয়েলিটির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, তাহলে দর্শক সব সময় তাঁদের সঙ্গে থাকবে। আমাদের এখানে অনেক ভালো নির্মাতা আছেন, যাঁরা ভালো কাজ করতে চান। তাঁদেরকে দর্শক লেভেল থেকেও সাপোর্ট দেওয়া উচিত। নতুন কিছু ভালো হলে সবাই যেন অন্যকে দেখতে উৎসাহী করে, তাহলে নির্মাতারাও আত্মবিশ্বাস পাবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত