Ajker Patrika

দেশে বসেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বাড়ছে

আব্দুর রাজ্জাক খান, ঢাকা
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৫৯
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখায় ভর্তি কার্যক্রম চলছে। ছবি: সংগৃহীত
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখায় ভর্তি কার্যক্রম চলছে। ছবি: সংগৃহীত

গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বেড়েছে ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন বা আন্তদেশীয় শিক্ষার চাহিদা। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ দেশে থেকেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন। শাখা ক্যাম্পাস, অনলাইন শিক্ষা, আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব—এসব মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে যাচ্ছে বিশ্বমানের শিক্ষার দরজা।

সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কয়েক গুণ বেড়েছে। যদিও ভারত ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় এটি এখনো পিছিয়ে। গবেষণার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক স্টিফেন ফোর্বসসহ অনেকে। গবেষণাটি পরিচালনা করেন বিয়েট্রিস সেগুরা হারভে ও জ্যাক সুলেভান।

ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষার নানা ধরন

  • শাখা ক্যাম্পাস: বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি অন্য দেশে শাখা ক্যাম্পাস স্থাপন করে। এখানে মূল ক্যাম্পাসের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং ডিগ্রি দেওয়া হয় মূল ক্যাম্পাস থেকেই।
  • ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনারশিপ: স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ঘরেই বসে বিদেশি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পান।
  • ভ্যালিডেশন পার্টনারশিপ: স্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রোগ্রাম চালালেও মূল ডিগ্রিদাতা বিশ্ববিদ্যালয় তা স্বীকৃতি দেয়।
  • যৌথ বা দ্বৈত ডিগ্রি: দুটি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে কোর্স পরিচালনা করে এবং অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীদের যৌথভাবে ডিগ্রি দিয়ে থাকে।
  • দূরশিক্ষা বা অনলাইন শিক্ষা: এটি সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালিত হয়, কখনো কখনো স্থানীয় টিউশন বা স্টাডি সেন্টারের সহায়তায়ও থাকে।

আন্তদেশীয় শিক্ষায় আগ্রহ যে কারণে বাড়ছে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ধরনের শিক্ষার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল ২০২৫ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই প্রবণতার পেছনের কয়েকটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি করে বৈশ্বিক অংশীদারত্বে যুক্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও জ্ঞান স্থানান্তর আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি নিজেদের আন্তর্জাতিক প্রোফাইল ও অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বিষয়টি শুধুই ব্যবসায়িক নয়। অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক সীমাবদ্ধতা বা পারিবারিক কারণে বিদেশ যেতে না পারলেও দেশে বসেই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এখন তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষা আর শুধু সীমিত কিংবা বিদেশ গমননির্ভর নয়, হয়ে উঠছে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবসম্মত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা গ্রহণের পথ সহজ করছে।’

বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থী বনাম ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষার্থী

ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন। সবচেয়ে বেশি গেছেন আমেরিকা; এরপর আছে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়া। বাংলাদেশে এখনো উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার বছরে মাত্র ২৩ শতাংশ, যেখানে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে এই হার ৪২ শতাংশ এবং উন্নত দেশে ৭৯ শতাংশ। ফলে ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষাই হয়ে উঠছে একটি সম্ভাবনাময় সমাধান।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে আন্তদেশীয় শিক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। এরপরই আছে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রসবর্ডার এডুকেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

  • ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি: ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সরকার অনুমোদিত বিদেশি শাখা ক্যাম্পাস চালু করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু করেছে। ২০২৫ সালের কিউএস র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অবস্থান ২৬৫তম, যা বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ পান।
  • অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ কলেজ: ২০২১ সালে ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ কলেজ দেশে চালু করে তাদের ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রাম সরাসরি পরিচালিত হয় মোনাশ ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া এবং মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার তত্ত্বাবধানে।
  • এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধীন ইউটিএস কলেজও বাংলাদেশে অনুরূপ কার্যক্রম চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে।
  • আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে দেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হলো ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) এবং সাউথ এশিয়া ইউনিভার্সিটি।

বাংলাদেশে ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষার চাহিদা দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তা দেশের উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আর্থিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা এখন ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক মানের ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহজলভ্য। বিশেষ করে ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি, মোনাশ কলেজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বাংলাদেশে শিক্ষার নতুন দিক উন্মোচন করেছে। একই সঙ্গে এটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতেও ভূমিকা রাখছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত