Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা, প্রস্তুত থাকা জরুরি

অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী।

সাম্প্রতিক সময়ে পরপর অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ। কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সর্বত্র। এই হঠাৎ কম্পন-মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক খান

আব্দুর রাজ্জাক খান
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৩

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পরপর কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এই ধারাবাহিক ভূমিকম্পগুলোকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের প্রায় ছয়টি উৎপত্তিস্থল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি মিয়ানমার থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত। তবে আরেকটি নোয়াখালী থেকে সিলেট পর্যন্ত; এটি হলো প্লেট বাউন্ডারি ২। সম্প্রতি হওয়া ভূমিকম্পগুলো এই প্লেট বাউন্ডারিতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখানে অনেক শক্তি জমা হয়ে থাকায় ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ ছাড়া তৃতীয় এলাকা হলো প্লেট বাউন্ডারি ৩, যেটি সিলেট থেকে ভারতের দিকে চলে গেছে। এখানে এ পর্যন্ত দুটি ভূমিকম্প হয়েছে ৭ ও ৭.৫ মাত্রার। একটি ১৯১৮ সালে, শ্রীমঙ্গলে; আরেকটি ১৮৬৯ সালে, কাছাড় ভূমিকম্প। চতুর্থ উৎস হলো ডাউকি ফল্ট, যেখানে ১৮৯৭ সালে ৮.১ মাত্রার গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক হয়েছে। এতে ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও সোনামসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ ছাড়া মধুপুর ফল্ট, যমুনা সেতুর কাছে বগুড়া ও শেরপুরে ১৮৮৫ সালে ৭.১ মাত্রার বেঙ্গল আর্থকোয়েক হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায়, সামনে আরও ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এর মানে কি বড় কোনো ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছেন?

হ্যাঁ। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ইতিহাস অনুযায়ী ৭ মাত্রার ভূমিকম্প পাঁচ-ছয়বার ঘটেছে, ৮ মাত্রার দুবার। তাই ঝুঁকি সব সময় আছে। ভূমিকম্প এখন না এলেও ভবিষ্যতে আসবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

ঢাকার ভবনগুলোর গুণগত মান দুর্বল হওয়ার কারন কী?

নকশা ভালো হলেও মাঠপর্যায়ে নির্মাণে অনেক সময় তা ঠিকভাবে মেনে চলা হয় না। সারা বিশ্বে সাধারণত যে ব্যক্তি নকশা করেন, তিনি নিজেই কনস্ট্রাকশনের সময় তা সুপারভাইজ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে নকশা যিনি তৈরি করেন, তিনি প্রায়ই সুপারভিশনে অংশ নেন না। সে কারণে সুপারভিশনের অভাবে ভবনের গুণগত মান সন্তোষজনক থাকে না।

কোন ভবনে কী ধরনের দুর্বলতা দেখা দেয়? সমাধানের উপায় কী?

আমাদের ভবন মূলত দুই ধরনের। একটি ইটের ভবন, আরেকটি বিম-কলাম পদ্ধতির ভবন। ইটের দেয়াল পুরো ভবনের ভার বহন করে। অর্থাৎ, দেয়ালে কোনো ক্ষতি হলে পুরো ভবন অচল হয়ে পড়তে পারে। তাই ইটের দেয়ালে ক্র্যাক দেখামাত্র মজবুত করতে হবে। বিম-কলাম পদ্ধতির ভবনে লোড প্রথমে স্ল্যাবে আসে, তারপর বিমে এবং শেষে কলামে পৌঁছায়। কলাম যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো ভবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাই কলামকে কোনোভাবেই ক্র্যাক হতে দেওয়া যাবে না। যদি ক্র্যাক দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই সেটি দ্রুত মজবুত করতে হবে।

ভূমিকম্প হলে শিক্ষার্থীদের নিরাপদভাবে সরিয়ে নিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?

ভূমিকম্প হলে ভয় পেয়ে হঠাৎ বের হওয়া যাবে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে নিরাপদ অবস্থান নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বের হয়ে ফাঁকা জায়গায় নিরাপদে অবস্থান করতে হবে।

ভূমিকম্পের পরে কীভাবে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে? আমাদের দেশে ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোন প্রযুক্তি বা কৌশল ব্যবহার জরুরি?

তুরস্কে ভূমিকম্পে ভবন ধসে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। পরে উদ্ধারকাজে যে খরচ হয়েছিল, তার গড় হিসাব করে দেখা যায়, একজনকে উদ্ধারে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশে যদি একটি পাঁচ কাঠার প্লটে ১০টি ফ্ল্যাট থাকে এবং সেখানে ৫০ জন মানুষ থাকে, ভূমিকম্প-সহনীয় করার খরচ মাত্র ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিনজন মানুষকে উদ্ধার করার খরচের পরিবর্তে একই অর্থে পুরো ভবনকে মজবুত করা সম্ভব। আমাদের দেশে গার্মেন্টস শিল্পে ১০ বছর ধরে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, সেটি ব্যবহার করলেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

ভূমিকম্পে উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত ও কার্যকর করতে ফায়ার সার্ভিস কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারে? সরঞ্জাম, মহড়া এবং ভলান্টিয়ার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার?

আমাদের ফায়ার সার্ভিস যথেষ্ট সক্ষম; তাদের প্রশিক্ষণ আছে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও যথেষ্ট। তবে জরুরি বিষয় হলো ভুমিকম্প-সহনীয় ভবন তৈরি করা, নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করা, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সহযোগী একটি ফোর্স গঠন এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভলান্টিয়ার তৈরি করা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দেখা গেছে, ছোটখাটো সরঞ্জাম নিয়ে ভলান্টিয়াররাই উদ্ধারকাজে বেশি সহায়তা করেছিল।

সুতরাং, আমাদের মূল মনোযোগ দেওয়া উচিত ভলান্টিয়ার তৈরির দিকে। ফায়ার সার্ভিসে আরও বেশি লোকবল প্রয়োজন। ঢাকায় প্রায় ১৮টি ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্রকে ভিত্তি করে, যদি প্রতিটিতে ১ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভলান্টিয়ার তৈরি করা যায়, তাহলে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে অনেক শক্তিশালী করা সম্ভব।

ভূমিকম্প-আতঙ্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। এ ধরনের আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারে এবং মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে?

জাপান, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মাসে না হলেও প্রতি দুই মাস পর একটি মহড়া হয়। আগুনের বেল বাজিয়ে দেয়, অথবা ভূমিকম্পের বেল বাজানো হয়। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কোথায় দাঁড়াতে হবে, কীভাবে বের হতে হবে, তা চিহ্নিত করা থাকে। অর্থাৎ হঠাৎ করে ভূমিকম্প হলে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা হয়। এ থেকে বাঁচতে নিয়মিত মহড়া করতে হবে। সবার মাথায় ঢুকিয়ে ফেলা যে ভূমিকম্প আসতে পারে, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি রাখতে হবে। এর বিকল্প নেই।

দেশে ভূমিকম্পে শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত

সামিহা সিরাজী লাজ
সামিহা সিরাজী লাজ

এখনই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

সামিহা সিরাজী লাজ

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারক আমাদের রাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। ঢাকা শহরের পুরোনো দালান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ও অসংখ্য বহুতল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। ভূতত্ত্ববিদেরা জানাচ্ছেন, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প শহরের জন্য বিপজ্জনক। রাজউক বলছে, ৬.৯ মাত্রার কম্পনে ৪০ শতাংশ ভবন ধসে প্রায় ২ লাখ মানুষ নিহত হতে পারে। নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৩০০ ভবনকে ‘রেড অ্যালার্ট’ ঘোষণা করেছে। নদীমাতৃক এই দেশে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা পরিণত হতে পারে বিপর্যয়ের কেন্দ্রে। নিরাপদ ভবন এবং প্রস্তুতির জন্য এখনই সবার কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।

মুজাহিদ আল রিফাত।
মুজাহিদ আল রিফাত।

অজানা এক ভয়ের মুখোমুখি

মুজাহিদ আল রিফাত

শিক্ষার্থী, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ ভূ-কম্পন মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। শহর ঘনবসতি, নরম মাটি, পুরোনো ও নকশাবহির্ভূত ভবন বড় বিপদের ইঙ্গিত দেয়। ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো পর্যায়ক্রমে পরিদর্শন করা হয় না এবং উদ্ধারকারী সংস্থার সক্ষমতা বড় দুর্যোগের তুলনায় সীমিত। মানুষও মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়; জরুরি ব্যাগ, নিরাপদ স্থান বা মহড়া নেই। আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। বড় কোনো কম্পনে দ্রুত উদ্ধার সম্ভব হবে কি না সন্দেহজনক। তাই ঢাকা এখন অজানা এক ভয়ের মুখোমুখি, যেখানে পরবর্তী কম্পন শুধু নাড়াবে না, বরং অপ্রস্তুতির কঠিন বাস্তবতাও প্রকাশ করবে।

সাজিয়া রহমান ঈশি।
সাজিয়া রহমান ঈশি।

শহরে খোলা জায়গার অভাব

সাজিয়া রহমান ঈশি

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল ভবন নির্মাণ ঢাকার ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। খোলা মাঠ ও নিরাপদ স্থান কমে যাওয়ায় জরুরি আশ্রয় নেওয়া কঠিন হচ্ছে। অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল নয় এবং সাধারণ মানুষও করণীয় জানে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ধারকারী দলের সক্ষমতা বাড়ানো, খোলা স্থান সংরক্ষণ ও বিল্ডিং কোড কার্যকর করা জরুরি। অবৈধ উচ্ছেদ ও সঠিক নগরায়ণ ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ভূমিকম্প দেশের জন্য অপ্রতিরোধ্য মানসিক ও আর্থিক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। সম্মিলিত প্রস্তুতিই একমাত্র নিরাপত্তার পথ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ