Ajker Patrika

শেয়ারবাজারে লাভ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর, লোকসান সাধারণের

  • পুঁজিবাজার ক্যাসিনো হয়ে গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ওনারশিপ নেবে: আমীর খসরু
  • ২০১০-১১ সালে লুট ২০ হাজার কোটি, পাচার ১৫ হাজার কোটি টাকা: ড. দেবপ্রিয়
  • শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দিয়ে পুঁজিবাজার কখনো দাঁড়ায় না: ড. মাশরুর রিয়াজ
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৫ মে ২০২৫, ১০: ৫৭
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার: দর্শন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক সংলাপে সিপিডির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর নিকুঞ্জে অবস্থিত ডিএসই মাল্টিপারপাস হলে। ছবি: আজকের পত্রিকা
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার: দর্শন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক সংলাপে সিপিডির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর নিকুঞ্জে অবস্থিত ডিএসই মাল্টিপারপাস হলে। ছবি: আজকের পত্রিকা

অনিয়ম ও দুঃশাসনে পঙ্গু হয়ে গেছে দেশের পুঁজিবাজার। এখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পুঁজিবাজার পরিণত হয়েছে জুয়াখেলার ক্যাসিনোতে। যেখানে মুনাফা কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর, আর লোকসান সাধারণ বিনিয়োগকারীর। এর কারণ, পুঁজিবাজারে কারসাজির শাস্তি না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে কেউ পুঁজিবাজারের দায়িত্ব (পলিটিক্যাল ওনারশিপ) গ্রহণ করেনি।

রাজধানীর নিকুঞ্জে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাল্টিপারপাস হলে গতকাল শনিবার পুঁজিবাজার নিয়ে এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার: দর্শন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)।

ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ও আলোচক ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে পুঁজিবাজারকে ক্যাসিনোতে পরিণত করা হয়েছে উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ক্যাসিনোতে পরিণত হয়েছে, এটা আর পুঁজিবাজার নেই। একটি গোষ্ঠী এই ক্যাসিনোর মালিক। আপনি ক্যাসিনোতে ঢুকবেন, খেলবেন, কিন্তু দিনের শেষে মুনাফা যাবে সেই মালিকের ঘরে।’

আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি পুঁজিবাজারের দায়িত্ব (ওনারশিপ) নেবে উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘ক্যাপিটাল মার্কেটকে রাজনৈতিক মালিকানার আওতায় আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ এ জায়গাটাতে হাত দিতে চায় না। পুঁজিবাজারের যত সংস্কার, সব বিএনপির সময় হয়েছে। আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে আমরা পুঁজিবাজারের ওনারশিপ নেব।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ২০১০-১১ সালে পুঁজিবাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন, যার মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে।

শাস্তি না হলে অন্যায় ও দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি, ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পথে বসেছে, অথচ সে সময়কার ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এটি ছিল পাপের সূত্রপাত।’

টোটকা ওষুধে পুঁজিবাজার ঠিক হবে না উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, এই বাজারের ধাক্কা পুরো অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে দেবপ্রিয় বলেন, দিন আনে দিন খায়—এমন মানসিকতা পুঁজিবাজারের সঙ্গে যায় না। একে সচল করতে হলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। তারপরও কাজ না হলে বুঝতে হবে, বড় ধরনের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার মোহসিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আইপিও প্রক্রিয়া সহজ করাসহ পুঁজিবাজারে বিভিন্ন মেয়াদে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মোবারক হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বাজেটের ২৫ শতাংশ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ড্রেনেজে চলে যাচ্ছে। এটা রোধ করা গেলে দেশের অর্থনীতি ভালো হবে। পুঁজিবাজারসহ দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবিন বলেন, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমস্যা সমাধানের অর্থনৈতিক থিওরি আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ও অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী পায়নি পুঁজিবাজার। পৃথিবীর অন্যান্য পুঁজিবাজারে দরপতন হলে ঘুরে দাঁড়ায় (বাউন্স ব্যাক), কিন্তু আমাদের দেশে সেই কাঠামো কাজ করে না। এ ক্ষেত্রে যে কারসাজি আছে, সেখান থেকে আমরা উঠে আসতে পারিনি।’

ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেটা কীভাবে ফিরিয়ে আনব, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।’

সিএসইর চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সংকুচিত ছিল, আরও হয়ে আসছে। পুঁজিবাজার পতনের সংস্কৃতির পেছনের কারণ হলো আইনের প্রয়োগের অভাব।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর খরা রয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আছে, সেটা খারাপ বলব না। কিন্তু এটা দিয়ে পুঁজিবাজার কোথাও দাঁড়ায় না। পুঁজিবাজার প্রতিদিনের ভিত্তিতে টাকা বানানোর জায়গা নয়। এটা দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রক্রিয়া এবং সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী খুব প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইসিএমএবির সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স (বিডি) লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইফতি ইসলাম প্রমুখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত