Ajker Patrika

নর্ডিক কোম্পানিগুলোর সফলতার রহস্য কী

অনলাইন ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জনসংখ্যায় ক্ষুদ্র, কিন্তু প্রভাবের বিচারে বিশাল নর্ডিক দেশগুলো যেন এক অর্থনৈতিক বিস্ময়। সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড—এই চার দেশের জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক আকার যতই ছোট হোক না কেন, এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে আইকিয়া, লেগো, স্পটিফাই, নোভো নর্ডিস্ক, নোকিয়া ও কার্লসবার্গের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলো। কীভাবে এত সীমিত সম্পদের মধ্যেও এই দেশগুলো থেকে উঠে এসেছে এত উদ্ভাবনী ও টেকসই করপোরেট প্রতিষ্ঠান? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই উঠে এসেছে একাধিক ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান; যা শুধু নর্ডিক অঞ্চলের নয়, বরং যেকোনো দেশের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হতে পারে।

এ নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনের শুরুতেই ডেনমার্কের কার্লসবার্গ কোম্পানির সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোপেনহেগেনের ‘কার্লস ভিলা’ আজও এক অক্ষত ধ্রুপদি ভাস্কর্য। ১৮৯২ সালে আর্ট নুভো ধাঁচে তৈরি বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন কার্লসবার্গ প্রতিষ্ঠাতার ছেলে কার্ল জ্যাকবসেন। এখন এটি বৈঠক কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয় কার্লসবার্গ কোম্পানির, যা আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিয়ার প্রস্তুতকারক।

বর্তমানে কার্লসবার্গের প্রধান নির্বাহী জ্যাকব আরুপ-আন্ডারসেন। তিনি স্বীকার করেছেন, কোম্পানির এই সাফল্য ডেনিশ কোম্পানিগুলোর একটি বৃহৎ ধাঁধার অংশ। তিনি বলেন, কেউ একজন তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন—এত ছোট একটি দেশ কীভাবে এত বড় বড় কোম্পানি তৈরি করেছে? তিনিও ব্যাপারটি নিয়ে পরে বেশ ভেবেছেন।

ডেনমার্কের ক্ষেত্রে যা সত্য, সেটি ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেনের ক্ষেত্রেও। চারটি বড় নর্ডিক দেশ বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ১ শতাংশ এবং জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হলেও তারা তৈরি করেছে বিশ্বখ্যাত করপোরেট জায়ান্টদের এক বিস্ময়কর তালিকা। লেগো এখন রাজস্বের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলনা কোম্পানি। আইকিয়া বিশ্বের বৃহত্তম আসবাব প্রস্তুতকারী এবং সুইডিশ মিটবল বিক্রির সুবাদে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রেস্তোরাঁ।

এই অঞ্চলেই তৈরি হয় মেশিনারি (অ্যাটলাস কপকো), টেলিকম যন্ত্রপাতি (নোকিয়া ও এরিকসন), সিটবেল্ট (অটোলিভ) এবং এলিভেটর (কোনে)। এখান থেকেই এসেছে বিশ্বসেরা মিউজিক স্ট্রিমিং কোম্পানি স্পটিফাই এবং সবচেয়ে বড় ‘বাই-নাউ-পে-লেটার’ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্লারনা। ওজন কমানোর ওষুধ তৈরিতে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান নোভো নর্ডিস্ক। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির একটি নতুন ওষুধের ট্রায়াল ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় শেয়ারের দর কমে যায়। এরপরও ইউরোপের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি নোভো নর্ডিস্ক।

গত এক দশকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় নর্ডিক কোম্পানিগুলো বেশি লাভ করেছে। এই চারটি দেশে তালিকাভুক্ত অ-আর্থিক কোম্পানিগুলো গত ১০ বছরে ইউরোপীয় গড়ের চেয়ে বেশি শেয়ারহোল্ডার রিটার্ন দিয়েছে। বর্তমানে এমএসসিআই ইউরোপ সূচকে নর্ডিক কোম্পানির অংশ ১৩ শতাংশ, যা পাঁচ বছর আগেও ছিল ১০ শতাংশ। এটি এখন জার্মান কোম্পানিগুলোর অংশের সমান।

এই অঞ্চলের শীর্ষ ২০টি কোম্পানিকে তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, তারা গড়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ২০২৩ সালে ৭ শতাংশ বেশি অপারেটিং মার্জিন এবং ৫ শতাংশ বেশি রিটার্ন অন ইনভেস্টেড ক্যাপিটাল পেয়েছে। ২০টি কোম্পানির মধ্যে ১৪টির ঋণের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। বার্ষিক বিক্রি বৃদ্ধিও ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমান।

অবশ্য সব নর্ডিক কোম্পানি সফল হয়নি। ব্যাটারি প্রস্তুতকারী নর্থভোল্ট সম্প্রতি দেউলিয়া হয়ে গেছে। নোকিয়ার হ্যান্ডসেট ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে আইফোনের কারণে। নর্ডিক দেশগুলোর এই সাফল্যে ভাগ্যেরও একটা ভূমিকা আছে। এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। কাঠ, লোহা (বিশেষ করে নরওয়েতে) তেল ও গ্যাস। তবে তা সত্ত্বেও তাদের সফলতা নজরকাড়া।

এই সাফল্যের পেছনের প্রথম কারণ নর্ডিক ব্যবসায়ীরা পূর্বসূরি ভাইকিংদের মতোই বিদেশমুখী বলে মনে করেন কার্লসবার্গের প্রধান নির্বাহী জ্যাকব আরুপ-আন্ডারসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ক্ষুদ্র আয়তন আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমুখী করতে বাধ্য করেছে।’ এই অঞ্চলের শীর্ষ ১০টি কোম্পানির গড় রাজস্বের মাত্র ২ শতাংশ আসে নিজ দেশ থেকে, বাকিটা বহির্বিশ্ব থেকে; যেখানে ইউরোপীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি ১২ শতাংশ আর আমেরিকায় ৪৬ শতাংশ।

দ্বিতীয় কারণ, দ্রুত প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে নেওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই লেগোর প্রতিষ্ঠাতা কাঠের বদলে প্লাস্টিক ব্যবহার শুরু করেন। আজও সেই উদ্ভাবনী চেতনা আছে। ইউরো স্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১০ জনের বেশি কর্মীসংবলিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে গড়ে ৪৫ শতাংশ ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা নেয়, অথচ নর্ডিক দেশগুলোয় এই হার ৭৩ শতাংশ।

এই প্রযুক্তিভিত্তিক মানসিকতার প্রভাব স্টার্টআপ সংস্কৃতিতেও রয়েছে। লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিন ছাড়া ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আসে স্টকহোমে, যদিও এর জনসংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। হেলসিংকিও গেম ডেভেলপারদের কেন্দ্র—রোভিও (অ্যাংরি বার্ডস) ও সুপারসেলের (ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস) জন্মভূমি। উদ্ভাবনে ব্যর্থ হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুরক্ষার কারণে ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেন তাঁরা।

তৃতীয় কারণ, সরকারি নীতিমালা। ব্যক্তিগত করের হার বেশি হলেও কোম্পানি করের হার যুক্তরাষ্ট্রের সমান। মার্কিন থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন—সব দেশই শীর্ষ দশে। ডেনমার্কে নিয়োগ ও ছাঁটাই সহজ; ভ্যাট নম্বরও পাওয়া যায় এক দিনে—যেখানে ফ্রান্সে এতে মাস লেগে যায়।

চতুর্থ কারণ, ধৈর্যশীল শেয়ারহোল্ডার। ম্যাকিন্সির মতে, ইউরোপে ৬০ শতাংশ এবং আমেরিকায় মাত্র ২০ শতাংশ কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি মালিকানার বিপরীতে নর্ডিক অঞ্চলে এটি ৮০ শতাংশ। এখানকার অনেক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে পরিবার বা ফাউন্ডেশন। উদাহরণস্বরূপ মায়ার্স্ক, লেগো, অ্যাটলাস কপকো ও এরিকসন।

এই ধৈর্যই কোম্পানিগুলোকে সময় দেয় ধীরে ধীরে বড় হওয়ার এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করার। ম্যাকিন্সির মতে, তালিকাভুক্ত নর্ডিক কোম্পানিগুলোর ৮০ শতাংশই গবেষণা ও উন্নয়নে প্রতিযোগীদের তুলনায় বেশি ব্যয় করে। নোভো নর্ডিস্কের প্রধান নির্বাহী লারস ফ্রুয়েরগার্ড জর্জেনসেন বলেন, তাঁর মূল ফোকাস হলো আগামী ১০-২০ বছরে কোম্পানির চেহারা কেমন হবে, তা নিয়ে কাজ করা।

তবে ভবিষ্যতে এই মডেল চাপের মুখে পড়তে পারে। বৈশ্বিক জিওপলিটিক অস্থিরতায় এই কোম্পানিগুলো বেশি ঝুঁকিতে। যেমন ২০২৩ সালে রাশিয়ায় কার্লসবার্গের ব্যবসা জব্দ করে ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনায়’ নেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসে কোম্পানিটি তাদের রুশ ব্যবসা বিশাল ছাড়ে স্থানীয় দুই কর্মীর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

মায়ার্স্কের জাহাজ ও কনটেইনার টার্মিনাল হুথি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে জন্য তারা সুয়েজ খাল এড়িয়ে চলছে, যা সময় ও ব্যয়ের চাপ বাড়াচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি সব আমদানির ওপর চড়া ট্যারিফ বসিয়েছেন। যদিও তিনি মূলত মেক্সিকো, কানাডা ও চীনকে লক্ষ্যবস্তু করছেন, তবুও তাঁর এই শুল্কনীতির প্রভাব পড়ছে সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর। শীর্ষ ১০টি নর্ডিক কোম্পানির এক-তৃতীয়াংশ বিক্রিই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই অবস্থায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নর্ডিক জায়ান্টরা।

এসব মোকাবিলায় নর্ডিক কোম্পানিগুলোর দরকার হবে আরও বেশি অভিযোজন ক্ষমতা। লেগোর সিইও নিলস ক্রিশ্চিয়ানসেন ডারউইনের একটি উক্তি তুলে ধরে বলেছেন, ‘সবচেয়ে শক্তিশালী নয়, বরং যে পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, সেই টিকে থাকে।’ বিশ্বজুড়ে যখন কোম্পানিগুলো ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন এই কথা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত