Ajker Patrika

কুষ্টিয়াই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী

ড. মো. শাহিনুর রহমান
আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৫: ৪৬
কুষ্টিয়াই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মরমি কবি লালন শাহ, গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথসহ বহু বিশিষ্টজনের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়া দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে খ্যাত।

কুষ্টিয়াকে কেন সাংস্কৃতিক রাজধানী করা উচিত, তার পেছনে অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে এখানকার স্থানীয় ভাষাকে, যা বাংলাদেশের আঞ্চলিক কথ্য ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রমিত বলে বিবেচিত। ১৯৪৭-এ ভারত তথা বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার পর প্রমিত বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, রাজধানী ঢাকার পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনোত্তর সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রমিত মানসম্পন্ন নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখনো অনেক গোঁজামিল রয়ে গেছে, কুষ্টিয়ায় ব্যবহৃত ভাষা জাতীয়ভাবে অনুশীলন ও ব্যবহার করে যা দূর করা যেতে পারে।

কুষ্টিয়া শহরের পাশেই কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া এলাকায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাউলসম্রাট লালন সাঁই। ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক ইংরেজি ১৭৭২ সালে  ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে মতান্তরে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক, ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন এবং তাঁকে এখানেই সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্যরা এখানে গড়ে তোলেন লালন আখড়া। ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের বর্তমান সমাধিসৌধটি ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমায় (মার্চ-এপ্রিল) এবং তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে লাখো ভক্ত সমবেত হন লালন আখড়ায়। এ সময় এখানে তিন দিন ধরে চলে সাধুসেবা, লালনের গানসহ লোকজ মেলা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের রচনাসহ বাংলা কাব্যে-সাহিত্যে, ভাবে-মননে লালনের তথা বাউল ভাবধারার প্রভাবও অসীম। সেই অর্থে লালন কবিগুরুর গুরুও বটে। সেই ফকির লালন সাঁইয়ের জন্মভূমিই বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী হবে, এতে কার দ্বিমত থাকতে পারে?

কুষ্টিয়ার আত্মাকে রবীন্দ্রনাথ ধারণ করেছেন তাঁর সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, খেয়া কবিতায়, গল্পগুচ্ছের বহু গল্পে, ছিন্নপত্রের চিঠিপত্রে। জীবনের সবচেয়ে কর্মময় আর সৃজনশীল দীর্ঘ একটি অধ্যায় কাটিয়েছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত এক দশক ধরে স্বল্প বিরতি বাদে প্রায় পুরোটা সময় কবি নিয়মিত এখানে থেকেছেন। এখানে বসেই কবি রচনা করেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’(১৮৯৬), ‘চৈতালি, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘ক্ষণিকা’, ‘নৈবেদ্য’ও ‘খেয়া’র অধিকাংশ কবিতাসহ আরও অনেক উল্লেখযোগ্য লেখা। এই  ১০ বছরে তিনি ঊনষাটটি ছোটগল্প লিখেছিলেন, যেসব গল্পের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন মূলত এ অঞ্চলের সাধারণ বাঙালি জীবনের নানা উপাদান ও আবেগ থেকে।  এখানে বসেই ১৯১২ সালে কবি তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

কুষ্টিয়া শহর থেকে ছয় কিলোমিটার এবং ছেঁউড়িয়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, ‘বিষাদসিন্ধু’র অমর স্রষ্টা মীর মশারফ হোসেনের বসতভিটা। ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর এখানেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলার মুসলিমদের বাংলা সাহিত্য সাধনায় টেনে আনতে সর্বাগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছেন মীর মশাররফ।

বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও সাংবাদিকতায় আরেকটি অগ্নিময় আলোকবর্তিকা ছিলেন কুষ্টিয়ার আরেক সুসন্তান হরিনাথ মজুমদার, কাঙ্গাল হরিনাথ নামেই যিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। ফকির লালন সাঁইয়ের শিষ্য হরিনাথ বহু প্রসিদ্ধ বাউলগানেরও স্রষ্টা। তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো’ গানটি বহু পুরস্কৃত ‘পথের পাঁচালী’ছবিতে ব্যবহার করেছেন বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। এসব গানের ভণিতায় ‘ফিকিরচাঁদ’নামটিও ব্যবহার করেছেন হরিনাথ। গুরু লালনের গানের পাশাপাশি ফিকিরচাঁদের গানও বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে, পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে তাঁর প্রধান অবদান প্রতিবাদী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে। একটা ছোট্ট গ্রাম্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতে জমির মালিক বা জমিদারদের অত্যাচারে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে এর প্রতিবাদে কিছু লেখার সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশ মালিকানাধীন নীল উৎপাদন কারখানায়ও তিনি একসময় কাজ করেছিলেন, আর সেই সূত্রে তিনি ছিলেন প্রজা-রায়তদের ওপর জমিদারদের পাশাপাশি নীলকর সাহেবদেরও নির্মমতম অত্যাচার-নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

 বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীধারদেনা করে এবং নিজের সামান্য সঞ্চয় সম্বল করে তিনি এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালে কুমারখালী থেকে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এই সূত্রে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে উপমহাদেশের প্রথম গ্রামীণ সাংবাদিক ও তদন্তকারী সাংবাদিক বলা যেতে পারে।

১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহ যখন সমগ্র বঙ্গ প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে, কুষ্টিয়া জেলার শালঘর মধুয়া অঞ্চল তখন এই আন্দোলনে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা নেয়, যা কুষ্টিয়ার সমস্ত নীলচাষিকে সরকারি কর প্রদান থেকে বিরত থাকতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও কুষ্টিয়া জেলার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেনানিবাসের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের ১৪৭ সদস্যের একটি দল ১৯ কুষ্টিয়ায় পৌঁছায়। তারা প্রথমে স্থানীয় থানা দখল করে এবং সেখানে একটি ফাঁড়ি স্থাপন করে। তবে শিগগিরই তারা পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ১ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুরোপুরি পরাভূত হয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার স্বদেশের ভূখণ্ডে তৎকালীন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। আরও পরে কুমারখালী উপজেলার বংশীতলা ও দৌলতপুর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তুমুল লড়াই করেন।

কুষ্টিয়া জেলায় বর্তমানে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। এর মধ্যে জেলাবাসীর প্রাণের দাবি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহর বাইপাস সড়ক, খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় সুইমিংপুল, হরিপুর সংযোগ সেতুর কাজ শেষের পথে। ভেড়ামারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, কুষ্টিয়া অনেকটা এগিয়ে গেছে। সবাই মনে করেন, এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। দেশের প্রাচীন জেলাগুলোর একটি কুষ্টিয়া। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণে এ জেলার মানুষ গর্বিত। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে কুষ্টিয়ার বাঘা যতীন, সরোজ আচার্য, অতুলকৃষ্ণের মতো স্বদেশি বিপ্লবীরা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কিছু পুরোনো জেলাকে বিভাগ ঘোষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর কুষ্টিয়া তথা মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাশের জেলা রাজবাড়ী ও ঝিনাইদহকে নিয়ে কুষ্টিয়া বিভাগ বানানো যেতে পারে।

জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে কলকাতায় এক জনসভায় কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। লালন বিশ্ববিদ্যালয় নামে কুষ্টিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এটি না হলে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সুষম উন্নয়ন অধরা স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। 

ড. মো. শাহিনুর রহমান
সাবেক উপ-উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন: 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত