Ajker Patrika

উড্ডয়নের অঙ্গীকারে অগ্রযাত্রা

আলমগীর জয়
উড্ডয়নের অঙ্গীকারে অগ্রযাত্রা

বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠা পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, কুমার ও ভুবনেশ্বর নদ–নদী বিধৌত প্রাচীন জেলা শহর ফরিদপুর। জেলার প্রায় সমগ্র অঞ্চল একসময় ছিল চরপ্রধান। ক্রমান্বয়ে এখানে বসতি সৃষ্টি হয়। স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশি চিন্তায় নিমগ্ন এ জেলার বিপুলসংখ্যক জনতা অনাদিকাল থেকেই ছিল চাপিয়ে দেওয়া শাসনব্যবস্থার বিরোধী। এ মনোভাবেই ব্রিটিশ শাসনের বিপক্ষে এই এলাকায় গড়ে উঠেছিল বিপুল জাগরণ। পাকিস্তানিদের দুর্বিষহ অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠে বাংলাদেশে সৃজন করেছিলেন এই পবিত্র ভূমিরই (বৃহত্তর ফরিদপুর) শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এই জেলার সোনালি আঁশ পাট জগদ্বিখ্যাত। কালো সোনা নামে খ্যাত পেঁয়াজবীজের সিংহভাগ উৎপাদনের তালিকায় এ জেলারই অবস্থান। দেশের প্রথম জিরা মসলা উৎপাদনে এই জেলার সন্তানেরাই ভূমিকা রেখেছেন। জেলায় বসতির শুরু থেকেই নানা পেশাজীবীর মধ্যে কৃষকদের প্রাধান্য ছিল।

বাংলাদেশের প্রথম কয়েকটি জেলার মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাবের পরপরই যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, ফরিদপুরে তখন জরুরি ভিত্তিতে ফরিদপুর ভার্চুয়াল স্কুল এবং বাংলায় আমার ঘরে আমার স্কুল চালু করা হয়। এর ফলে ফরিদপুরে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকাংশেই স্বাভাবিক রয়েছে। গত বছরের এপ্রিল-মে মাস থেকে গৃহীত ফরিদপুরের এই কার্যক্রম খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তা পরে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া শিক্ষার আলোকবর্তিকা সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে `আমার গ্রাম আমার শহর—ফরিদপুর হবে শিক্ষার নগর’ স্লোগান হৃদয়ে ধারণ করে ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের ব্যতিক্রমী ও অনন্য উদ্যোগ `মিট দ্য ডিসি’। এটি মূলত ফরিদপুর জেলা সদরে পৌরসভার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরা ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে জেলা প্রশাসকের সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের ক্ষেত্র।

ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ এবং সমাজে বিশেষত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুস্থ ধারার মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে প্রতি মাসে জেলায় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এবং উপজেলা পর্যায়ে অনুরূপভাবে শিক্ষার্থী বাছাই করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সঙ্গে এই কর্মসূচি যথাক্রমে ‘মিট দ্য ডিসি’ ও ‘মিট দ্য ইউএনও’ নামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

ফরিদপুরে অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তাদের সঞ্চিত টিফিনের অর্থ থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মাসে মাত্র ৫০ পয়সা (আট আনা) নিয়ে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এই ব্যতিক্রমী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে যে তাদের সামান্য অর্থের বিনিময়ে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা সম্ভব। এই কার্যক্রমকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য ‘জ্ঞানের আলো ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফরিদপুরের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ২৫০ বেড থেকে ১ হাজার বেডে উন্নীত করা হয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালের সেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। জেলার সালথা উপজেলায় অত্যাধুনিক মানের ৫০ বেডের একটি হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে চরপ্রধান ফরিদপুরে যাতায়াতের জন্য নৌযান ছিল প্রধান বাহন। সময়ের পরিক্রমায় আজ সেই স্থান দখল করেছে সড়ক ও রেলপথ। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার পুরো চিত্র বদলে দিয়েছে। ভাঙ্গা উপজেলা অংশে যে অত্যাধুনিক সড়ক দৃশ্যমান; তা কখনো কল্পনায়ও ছিল না।

ফরিদপুর জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য পাট। পাট ও পাটজাত বিভিন্ন দ্রব্যের স্থানীয় ও বৈদেশিক বাজার সৃষ্টি করে পাটকে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত করা, পাটচাষি ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকারিভাবে ফরিদপুর জেলায় আয়োজিত হয় মাসব্যাপী ব্র্যান্ডিং মেলা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার ‘মুজিববর্ষে দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না’ বাস্তবায়নে ফরিদপুর জেলার ২ হাজার ভূমিহীনকে ৩২৩ একর খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫৫৫ জন ভূমিহীনকে ৭৮ একর খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে গুচ্ছগ্রাম এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার ১ হাজার ৭১টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।

মুজিববর্ষে ফরিদপুর জেলার প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা পরিষদের নিজস্ব জায়গায় অথবা উপজেলা পরিষদকে ঘিরে মুজিববর্ষ পার্ক নামে দৃষ্টিনন্দন পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ জেলার কয়েকটি উপজেলায় তা প্রায় সমাপ্ত হয়েছে। এ জেলার ৮১ টি ইউনিয়ন পরিষদে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে অব্যবহৃত কোনো কক্ষে অথবা ইউনিয়ন পরিষদের জায়গায় নিজস্ব অর্থায়নে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ গণগ্রন্থাগার’ নামে একটি করে লাইব্রেরি গড়ে তোলা হচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং এর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা। এই করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, জনসচেতনতা তৈরি, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনাসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড সুচারুভাবে সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে ফরিদপুরে ‘ফরিদপুর করোনা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিলিফ অপারেশন’ শীর্ষক একটি ওয়েবসাইট প্রণয়ন করা হয়। এই ওয়েবসাইটে একদিকে যেমন মানবিক সহায়তাপ্রাপ্ত এবং প্রাপ্তিযোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা সংরক্ষণ করা হচ্ছে, অপরদিকে এ জেলার করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, তাদের টেস্ট সম্পর্কিত তথ্য, করোনা থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যা, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ও হোম কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা নিয়মিত আপডেট করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। উপজেলাভিত্তিক করোনা আক্রান্তদের তথ্য থাকায় কোনো নির্দিষ্ট এলাকাবাসীও নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করে সে অনুযায়ী নিজেরা সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন।

বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, টিআর, কাবিটা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সরকারের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী রয়েছে। 

আলমগীর জয়
সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত