Ajker Patrika

বিলুপ্তির পথে ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, সংরক্ষণের দাবি 

সাদ্দাম হোসেন, ঠাকুরগাঁও
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫: ৫০
বিলুপ্তির পথে ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, সংরক্ষণের দাবি 

সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী এ রাজবাড়িটি যেকোনো সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ঝুঁকিপূর্ণ যেনেও ঐতিহাসিক এ রাজবাড়ি একনজর দেখতে অনেকে আসছেন। 

জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত এ রাজবাড়ি রানীশংকৈল উপজেলার কাতিহার নামক স্থানে যা বর্তমান কুলিক নদীর তীরে অবস্থিত। সেখানে গোয়ালা বংশের এক নিঃসন্তান জমিদার বসবাস করতেন। সেই জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরে সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। নিঃসন্তান বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার ভারতের কাশীবাসে যজ্ঞে যাওয়ার সময় তাঁর সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান। তাম্রপাতে দলিল করে যান যে তিনি কাশী থেকে ফিরে না এলে শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত এই জমিদারির মালিক হবেন। পরে বৃদ্ধ জমিদার ফিরে না আসার কারণে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারি পেয়ে যান। 

রাজা টঙ্গনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ চৌধুরী রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করলেও সমাপ্ত করেন তাঁর ছেলে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে চৌধুরী ও দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের কাছ থেকে রাজা পদবি পান টঙ্কনাথ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর টঙ্গনাথ সপরিবারে ভারতে চলে যায়। পরে রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে অধিগ্রহণ করে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। অপূর্ব নির্মাণশৈলী এ বাড়ির প্রতি বরাবরই দর্শনার্থীদের আকর্ষণ ছিল। বিশেষ করে বাড়িটির মার্বেল পাথর ও দারুণ কারুকার্য দৃষ্টি কাড়ত সবার। 

ধ্বংসের পথে রানীশংকৈল উপজেলার ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যেনেও তা একনজর দেখতে অনেকে আসছেনবর্তমানে রাজবাড়ির অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় ১০ একর জুড়ে নির্মিত এ প্রাসাদটি এখন পর্যন্ত সুরক্ষা বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। রাজবাড়ির পূর্বদিকে দুটি পুকুর রয়েছে যা ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব। পুকুরের ঘাটগুলো ভেঙে গেছে, সংস্কার করা হয়নি। 

দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট এ রাজ প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে ৮০ টির মতো ঘর। কিন্তু সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ঘরগুলো এখন বিলীনের পথে। যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে এ রাজপ্রাসাদটি। এর মধ্যে প্রাসাদের ভেতরে দ্বিতল ভবনে ওঠা সিঁড়ির প্রায় ৪ ফিট ধসে পড়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বাড়ির বেশ কিছু অংশ। চুরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ির অবকাঠামো তৈরির লোহা, দরজা, জানালা ও বিভিন্ন জিনিস। হারিয়ে যেতে বসা এ রাজবাড়িটি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন রানীশংকৈল উপজেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। 

রাজবাড়ি ঘুরতে আসা মরিয়ম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, প্রায় সময় আগে ঘুরতে আসতাম এখানে। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ আর নেই। 

ধ্বংসের পথে রানীশংকৈল উপজেলার ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যেনেও তা একনজর দেখতে অনেকে আসছেনসামাজিক নিরাপত্তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ভেতরের স্থাপনাগুলোতে লতাপাতা ও পরগাছায় ছেয়ে গেছে। এ সুযোগে মাদকসেবীরা সেখানে মাদক ও জুয়ার আসর বসিয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে আর সামনে যাইনি। 

পরিবার নিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে ঘুরতে আসা রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলে এখনো এই রাজবাড়িকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় ও নিরাপদ করে তুলতে পারবেন। 

রাজবাড়িতে ঘুরতে আসা কলেজছাত্র লিমন বলেন, এই রাজবাড়িটি খুব সুন্দর। সে কারণেই এখানে বেশ কয়েকবার আসা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোন ধরনের স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে নারীদের দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে বেশি। 

ধ্বংসের পথে রানীশংকৈল উপজেলার ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যেনেও তা একনজর দেখতে অনেকে আসছেনস্থানীয় বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন বলেন, বাড়িটি সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। না হলে এর স্থাপত্যগুলো অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। 

একই উপজেলার জগদল বাজারের স্কুলশিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা টঙ্গনাথের রাজবাড়িতে এখন সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় আপত্তিকর কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া ও গাঁজার আসর। একইভাবে দিনের বেলায় থাকে গরু-ছাগলের দখলে। যেন রাজবাড়িটি গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেসব দেখার যেন কেউ নেই।

এ বিষয়ে রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, রাজা টঙ্গনাথ ভারতে চলে যাওয়ার পরে সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে অধিগ্রহণ করলেও এত দিন স্থানীয়রা দখল করে রেখেছিল। গেল দু-এক বছর আগে জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাড়িটি দখল মুক্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়টাতে সরকারের তদারকির অভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পড়ে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যায়। দখলকারীরা অনেকে বাড়ির ইটসহ নানা স্থাপনা নিয়ে চলে গেছে। বাড়ির অবকাঠামো চুরি না হলে এ ভঙ্গুর দশা থেকে আরও ১০০ বছর পর্যন্ত বাড়িটি সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকত। 

ধ্বংসের পথে রানীশংকৈল উপজেলার ঐতিহাসিক টঙ্গনাথের রাজবাড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যেনেও তা একনজর দেখতে অনেকে আসছেনঅধ্যাপক আরও বলেন, এরই মধ্যে এ উপজেলার ৪টি জমিদার বাড়ি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে জগদল ধর্মগড় গ্রামে জমিদার ধীরন্দ্র নাথ রায় বাড়িটি অন্যতম। টঙ্গনাথের রাজবাড়িটি এখনকার পরিস্থিতি যা দেখা যায় তা দেখে মনে হচ্ছে এটাও জমিদার বাড়িটির মতই ধসের পথে। 

ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করা সবার দায়িত্ব জানিয়ে অধ্যাপক বলেন, বাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েক বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর সুরক্ষা বা সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এটিকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারত পর্যটনকেন্দ্র। এতে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক এ রাজবাড়ি দর্শনার্থীদের মনের খোরাক জোগাবে। 

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান (ডিসি) আজকের পত্রিকাকে বলেন, রানীশংকৈলে টঙ্গনাথের রাজবাড়িকে সংরক্ষণ ও পর্যটনকেন্দ্রে হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে একটি এস্টিমেন্ট তৈরি করে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে পাঠানো হবে।  

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত