Ajker Patrika

একসঙ্গে মাঠে ঘাম, সেই মাঠেই বৈষম্য

সাদ্দাম হোসেন, ঠাকুরগাঁও
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৫৪
দুপুরের খাবার খাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
দুপুরের খাবার খাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

চলছে আমন মৌসুম। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ধন্দগাঁও এলাকায় শনিবার দুপুরে একদল কৃষিশ্রমিক আমনের চারা রোপণের ফাঁকে মাঠের এক কোণে পুকুরঘাটে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। কারও পাতে আলুভর্তা, কারও বেগুনভাজি, কারও লাউয়ের ঘন্ট। কেউ আবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন ডিমভাজি আর ছোট মাছের ঝোল।

২৫ সদস্যের এই শ্রমিক দলে ১৪ জনই নারী। কিন্তু নারী-পুরুষ সবাই মিলে একসঙ্গে মাঠে কাজ করলেও মজুরির অঙ্কে রয়েছে বড় ফারাক। নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ৫০০ টাকা, আর একই কাজ করে পুরুষেরা নিচ্ছেন ৭০০ টাকা।

একই রোদে ঘাম, একই কাদায় পা; তবু এই বৈষম্যের কথা বলতেই চোখ ভিজে ওঠে ফুলবানু ও বীণা রানীর। ফুলবানু বলেন, ‘সকালে স্বামী-সন্তানকে রান্না করে খাইয়ে রেখে আমরা মাঠে আসি। সারা দিন ছায়া ছাড়া পা ডুবিয়ে চারা রোপণ করি। তবু আমাদের মজুরি কম। এটা কি ন্যায্য?’

বীণা রানী বলেন, ‘আমরা নারী বলেই পারিশ্রমিক কম, এমনটা কেন চলবে?’

এই শ্রমিক দলের নেতৃত্বে থাকা মঙ্গলু রায়কে সবাই ‘সরদার’ বলেন। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করলেও নারী বলেই তাঁদের মজুরি কম। এটা আমাদের নিয়ম।’

মঙ্গলুর এই কথার প্রতিবাদে মুখ খোলেননি কেউ, তবে পাশে বসে থাকা মীনা রানী নীরবে চোখ মুছছিলেন। তিনি শুধু বলেন, ‘নারী হওয়াটাই যেন অভিশাপ।’ এই শ্রমিকেরা সবাই সদর উপজেলার গৌরীপুর এলাকার বাসিন্দা।

পরেশ রায় নামের এক পুরুষ শ্রমিক জানান, এক বিঘা জমিতে চারা রোপণের চুক্তিমূল্য ৩ হাজার টাকা। দল বেঁধে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় বিঘা জমিতে কাজ করেন তাঁরা। কিন্তু মজুরির বণ্টনে বৈষম্য থেকেই যায়।

শুধু ধন্দগাঁও নয়, ঠাকুরগাঁও জেলার প্রায় প্রতিটি এলাকায় একই চিত্র। রানীশংকৈল উপজেলার কুমারপুর গ্রামে মাঠে চারা রোপণ করছিলেন মালেকা বেগম। তিনি বলেন, ‘পুরুষদের সমান কাজ করি। কিন্তু মজুরি পাই কম। অনেক সময় না দিলে জায়গা পাই না। মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়।’

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা এলাকার শ্রমিক কল্পনা রানী বলেন, ‘আমরা তো হেঁটে গিয়ে হেঁটে ফিরি। পুরুষেরা অনেক সময় বাইকে আসে। তারপরও তাদের মজুরি বেশি। আর আমাদের চুপ থাকতে হয়।’

ঠাকুরগাঁও শহরের বেসিক শিল্পনগরী এলাকায় একটি প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক রুমি আক্তার বলেন, ‘আমরা দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করি। পুরুষ কর্মীরা অনেক সময় কম কাজ করলেও তাদের মজুরি আমাদের চেয়ে বেশি।’ একই কারখানার আরেক নারী শ্রমিক শাপলা বেগম বলেন, ‘প্রতি মাসে পুরুষদের ১০-১২ হাজার টাকা মজুরি, আর আমাদের ৮ হাজার। অথচ কাজের চাপ আমাদের ওপরই বেশি।’

ঠাকুরগাঁওয়ের নারী ও শিশুকল্যাণ কর্মী ফারজানা খাতুন বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না। সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অধিকার রক্ষা ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থাকবে।’

ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে। এই বিশাল এলাকাজুড়ে রোপা আমন লাগানোর কাজে নারীদের অংশগ্রহণ এখন চোখে পড়ার মতো। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়ছে পারিশ্রমিক বৈষম্যের অভিযোগ। তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে নারীরা কৃষি শ্রমে আগ্রহ হারাবে। স্থানীয় পর্যায়ে এই বৈষম্য দূর করতে সমবায় পদ্ধতিতে কাজ ভাগাভাগির চিন্তা করা যেতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ডিঞ্জের পাশে রেলসেতু

স্বরূপকাঠিতে বিএনপি সভাপতিকে ‘আ.লীগের দোসর’ বললেন পরাজিত প্রার্থী

বরযাত্রীদের বিলাসবহুল গাড়ি উঠে গেল কলেজের দেয়ালে, বরসহ নিহত ৮

ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচে বাংলাদেশের আম্পায়ারকে নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণ কী

১৪ হাজার কোটি রুপি কেলেঙ্কারি, ভারতের মোদির ভাই যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত