Ajker Patrika

ফারাক্কা লংমার্চ দিবস আজ

সেচের ক্ষতিতে ৬ কোটি মানুষ

  • পানির হিস্যা আদায় হয়নি।
  • গ্যারান্টি ক্লজ অন্তর্ভুক্ত, তবে চুক্তি নবায়নের তাগিদ।
  • গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ শতাধিক নদ-নদী ক্রমেই রূপ নিচ্ছে মৃত খালে।
 রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ০৮: ১৩
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস আজ শুক্রবার। পদ্মার উজানে ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি করে পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে জমায়েত হয়েছিলেন। এখান থেকেই সেদিন মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ শুরু হয়েছিল। পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেদিন লাখো জনতার বজ্রকণ্ঠে যে প্রতিবাদ উঠেছিল, তার প্রতিধ্বনি পৌঁছেছিল দিল্লিতে। পানির জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদের ঘটনা।

সমবেত জনতার উদ্দেশে সেদিন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না, কারও হুমকিকে পরোয়া করে না। আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হলো তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির রুখে দাঁড়ানোর জ্বলন্ত নজির। নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে।’

গবেষকেরা বলছেন, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ ষোলো আনা সফল হয়েছিল। ফারাক্কা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল এই লংমার্চের পর। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয় ইস্যুকে ভিত্তি করে। ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ভারত ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানিপ্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল।

চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল, যা সঠিকভাবেই কার্যকর ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী, বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। আর ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোনো কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ। ৫ বছরমেয়াদি এ চুক্তিটি জাতিসংঘে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালে ৫ বছরমেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলেও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি। এরপর কয়েকবার সমঝোতা স্মারক হলেও বাংলাদেশ আর পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি।

সেচের অভাবে ৬ কোটি মানুষ

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে অংশ নিয়েছিলেন নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও রাজনীতিক মাহমুদ জামাল কাদেরী। ফারাক্কা লংমার্চ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা জানান, যতই দিন গড়াচ্ছে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে, আতঙ্কিত করছে। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার একটি নিয়মিত ঘটনা। পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ শতাধিক নদ-নদী ক্রমেই মৃত খালে রূপ নিচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের অন্তত ৬ কোটি মানুষ সেচসংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও ৪ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির শিকার। ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে পানির ঘাটতির ফলে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে এসেছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের শতভাগ অগভীর নলকূপ এবং অনেক এলাকার অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে অনেক এলাকায় নলকূপের পানি পানযোগ্য নেই।

মাহবুব সিদ্দিকী অভিযোগ করেন, ভারতের উত্তরাখন্ড, উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে গঙ্গার প্রায় ৪০০ পয়েন্ট থেকে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আপার, মধ্য ও নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের মাধ্যমে বিশাল এলাকায় এই পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর শতভাগ দায়ভার ভারতের।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, গত ৪০ বছরে গঙ্গার আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পানি নেই বলে ইলিশ আর আসে না, ডলফিন আর ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশে গঙ্গার আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ, পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি গঙ্গায় পানিপ্রবাহ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক, যা ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি এসে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেকে। এক বছরের ব্যবধানে পানি কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক।

সংবাদ সম্মেলনে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা, নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের মতো গ্যারান্টি ক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা, যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে যুক্তকরণ এবং নির্ধারিত সময়ে বৈঠক করা, অভিন্ন নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ দল গঠন ও ভারতকে তালিকা জানানো, ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা, জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীন, ভুটান ও মিয়ানমারকে নিয়ে আঞ্চলিক নদী ফোরাম গঠন করা; গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ সব নদীর পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা।

লংমার্চ দিবসের কর্মসূচি

আজ শুক্রবার রাজশাহীতে র‍্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বেলা ৩টায় রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করবে ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন কমিটি। র‍্যালি শেষে বিকেল ৪টায় রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত