Ajker Patrika

দোতারার সুরে সংসারের লড়াই

আব্দুল্লাহ আল মারুফ, কামারখন্দ (সিরাজগঞ্জ) 
দোতারা হাতে গান গাইছেন মিলন, পাশে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে আমজাদ। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার হাটখোলা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
দোতারা হাতে গান গাইছেন মিলন, পাশে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে আমজাদ। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার হাটখোলা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার হাটখোলার চায়ের দোকান। চারপাশে মানুষের ব্যস্ততা, ধোঁয়া ওঠা কাপ আর গল্পগুজবের মধ্যে এক কোনায় বসে আছেন এক মানুষ। চোখে ক্লান্তির ছাপ, হাতে দোতারা। গলায় ভেসে আসছে এক ব্যথাভরা সুর—

‘যদি আমায় ভালোবাসো নব সেজে এসো

এসে বইসো আমার হৃদয় মন্দিরে...’

সেই গানের সুরে তাল মেলাচ্ছে ১৭ বছরের কিশোর আমজাদ, হাতে ঝুনঝুনি। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে শুনছেন। কেউ আবার চুপিচুপি টেবিলে রেখে যাচ্ছেন কয়েন বা কড়ি— সহানুভূতির নীরব ভাষা। এই গান কেবল বিনোদন নয়, এক বাবার জীবনযুদ্ধের প্রতিদিনের ডায়েরি।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মোহাম্মদ মিলন, বয়স আনুমানিক ৩৫-৩৭। বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জে। চোখে ঝাপসা, চলাফেরা কষ্টসাধ্য। কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি। প্রতিদিন দোতারা কাঁধে বেরিয়ে পড়েন গান গেয়ে রোজগারের আশায়।

মিলন হাটখোলায় ‘আজকের পত্রিকা’র সঙ্গে আলাপে বলেন, ‘আগে মাঝেমধ্যে গাইতাম, এখন গানই আমার পেশা। না গাইলে সংসার চলে না।’

তার সংসারে স্ত্রী ও তিন সন্তান। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে পড়ে আর ছোট ছেলে স্কুলে যাওয়ার বয়সেই পা রাখেনি। মিলনের আয়ের ওপর নির্ভর করে তাদের খাবার, পড়াশোনা ও চিকিৎসা— সবকিছু।

সম্পত্তি বলতে বাবার রেখে যাওয়া মাত্র ২ শতাংশ ভিটেমাটি। খাবার থাকবে কি না, সেটা নির্ভর করে প্রতিদিন দোতারার সুরে মানুষ কতটুকু সাড়া দেয় তার ওপর। হাট-বাজার, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড—এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় গান করে যা পান, তাই নিয়ে ফিরে যান বাড়ি।

গ্রামের হাটবাজার, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, চায়ের স্টল এ যেন তার মঞ্চ। কখনো ১৫ দিন, কখনো মাসখানেক তিনি বাড়ির বাইরে থাকেন। দোতারার সুরে সুরে মানুষের মন ছুঁয়ে যা পান, তাই নিয়ে ঘরে ফেরেন।

মিলন আজকের পত্রিকাকে আরও বলেন, দিনে গান শোনার পর মানুষ দু-চার-পাঁচ টাকা যা দেয়, তা দিয়েই টেনেটুনে কষ্ট করে চলতে হয়। এখনকার বাজারে এ টাকায় সংসার চালাতে খুব কষ্ট।

তার পাশেই চুপ করে হাতে ঝুনঝুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমজাদ হোসেন। বয়স মাত্র ১৭। মিলনের এলাকার ছোটভাই। সেও জানে, এই মানুষটার গান থেমে গেলে থেমে যাবে পাঁচজনের জীবন। মিলনের এখন একটাই স্বপ্ন, একটা ভালো জায়গায় গাইবার সুযোগ পেলে অন্তত বাচ্চাগুলোর মুখে একটু হাসি ফোটে। ওদের ভবিষ্যৎ তো গানের ভেতরেই বাঁধা পড়ে আছে।

মিলনের কণ্ঠে হতাশা আছে, কিন্তু ভেঙে পড়া নেই। তার চোখে জেদ—জীবন থেমে নেই, থামবেও না। তাঁর দোতারায় যখন সুর বাজে, তখন সেখানে শুধু লালনের গান নয়, বাজে একজন বাবার না বলা কথা। বাজে ভালোবাসার গল্প, ক্ষুধার ভাষা, স্বপ্নের আর্তনাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত