Ajker Patrika

এসপিবিকের অনিয়ম: ধারের শিক্ষার্থী দেখিয়ে অর্থ লোপাট

ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ  
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৫৪
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ঝরে পড়া ও পথশিশুদের আলোর পথ দেখাতে ময়মনসিংহে চার বছর মেয়াদি ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্রের (এসপিবিকে) বিরুদ্ধে। অস্তিত্বহীন অধিকাংশ কেন্দ্র ও ধার করা শিক্ষার্থীকে কাগজ-কলমে দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে টাকা। লোপাটের এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হলেও শিক্ষক-সুপারভাইজাররা এখনো তাঁদের পুরো বেতন ও বাড়িভাড়া পাননি।

অভিযোগ রয়েছে, এসপিবিকের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও চেয়ারম্যান ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে প্রধান উপদেষ্টা করে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। শিক্ষা উপকরণ, উপবৃত্তি, পোশাক না দিয়ে টাকা তুলে করেছেন আত্মসাৎ। নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম না করেও শিক্ষকেরা বেতন নিয়েছেন মাসের পর মাস। গত ৫ আগস্টের পর তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন।

জানা গেছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে ২০২১ সালে ময়মনসিংহে ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে এ কার্যক্রম শুরু করে এসপিবিকে নামের একটি এনজিও। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ১০০ এবং সাত উপজেলায় ৪৯০টি কেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়া হয় ৫৯০ শিক্ষক এবং ৪৫ সুপারভাইজার। সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক কেন্দ্রে দুই শিফটে ৩০ জন করে ৬০ শিক্ষার্থী, ঘরভাড়া বাবদ ৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। তবে শিক্ষকেরা বলছেন, শুরুর দিকে ঘরভাড়া বাবদ ৩ হাজার করে পেলেও ২০২৩ সাল থেকে দেওয়া হয় আড়াই হাজার করে টাকা।

এই প্রকল্পে কতটুকু উপকৃত হয়েছে শিশুরা, তার খোঁজে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর থানার ঘাট এলাকায় গেলে আশরাফুল আলম নামের একজন বলেন, ‘এই প্রকল্পে শুধু লুটপাট হয়েছে। শিশুরা পড়াশোনাসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দুই শিফটে ৩০ জন করে ৬০ শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা করানোর কথা থাকলেও ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী উভয় শিফটে পড়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ছিল হাইস্কুল থেকে ধার করা।’

ওই এলাকার ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কেন্দ্রের শিক্ষক দীপা পাল বলেন, ‘উচ্চবিদ্যালয়ের ধার করা শিক্ষার্থী নিয়ে কেন্দ্র পরিচালনা করেছি, সেটা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী পাওয়া খুব কঠিন ছিল। কয়েক দিন আগে তিন মাসের বাড়িভাড়া মালিককে দিতে গেলেও তিনি ভেঙে টাকা নেননি।’

যুবলীঘাট নদের পারের কেন্দ্রের সামনে গেলে স্থানীয় রুবেল মিয়া নামে একজন বলেন, ‘এই কেন্দ্রে দু-একজন করে শিক্ষার্থী ধরে এনে পড়ানো হতো। কেন্দ্রের জায়গাটিও সরকারি; তবে শিক্ষিকা কাউকে বাড়িভাড়া দিয়েছেন কি না জানি না।’

এই কেন্দ্রে পড়াশোনা করা আসাদুজ্জামান আদ্র বলে, ‘প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কেন্দ্রেও পড়েছি। সেখান থেকে কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি। যেমন পোশাক, বই-খাতা, কলম। তাই বছর দেড়েক পড়েছি।’

কেন্দ্রের শিক্ষিকা ফারজানা বলেন, ‘দু-একজন নয়, ৬০ জন শিক্ষার্থী নিয়েই পড়াশোনা কার্যক্রম চালিয়েছি। আট মাসের বেতন ও বাড়িভাড়া এখনো পাইনি। যারা এসব বলছে, তারা না জেনে বলছে।’

পাটগুদাম রেলগেটে শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্রের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানকার শিক্ষক নিশি আক্তারও কেন্দ্রের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘দুই জায়গায় কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি; যাদের কাছ থেকে ঘরভাড়া নিয়েছিলাম তারা এখন অন্যত্র চলে যাওয়ায় তথ্য দিতে পারছি না। তাদের মোবাইল নম্বরও নেই।’

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ময়মনসিংহ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষক-সুপারভাইজারদের বকেয়া এক বছরের বেতন ও বাড়িভাড়ার মধ্যে সম্প্রতি তিন মাসের এবং আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরও তিন মাসের পরিশোধ করা হবে।

আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রামের ময়মনসিংহ সিটির সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘শুরু থেকেই প্রকল্পটির সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। হঠাৎ একদিন প্রকল্পটির জেলা ম্যানেজার এবং নির্বাহী পরিচালক আমাকে ডেকে নিয়ে প্রত্যেক শিক্ষক এবং সুপারভাইজারের কাছ থেকে ২০ হাজার করে টাকা নিতে বলেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করলে তাঁরা আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেন।’

জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক আবু ইউসুফ খান বলেন, প্রকল্পটির মাঠপর্যায়ে পুরোপুরি সফলতা না এলেও ইতিমধ্যে শিক্ষকদের তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বাড়িভাড়া এনজিওর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। আরও তিন মাসের বেতন প্রক্রিয়াধীন। বাকি ছয় মাসের বেতন, বাড়িভাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি দেয়, তাহলে আমরা এনজিওর মাধ্যমে পরিশোধ করব।’ তিনি বলেন, ‘সঠিক তদারকির অভাবে প্রকল্পটির শতভাগ সুফল আসেনি। আমি এই প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি; সেখানে ৩০ জনের মধ্যে শিক্ষার্থী পেয়েছি ১৫-২০ জন। বিভিন্ন কেন্দ্রে ১২ হাজার ৫৯৮ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করলেও ৮-১০ বছরের ৮ হাজার ১০২ জন শিক্ষার্থী মূল স্রোতে গিয়ে বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত