Ajker Patrika

মায়ের ‘কর্মসংস্থানে’ মেয়েদের সুরক্ষা

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রাম
বাড়িতে তাঁত মেশিনে শাড়ি বুনছেন এক নারী। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাড়িতে তাঁত মেশিনে শাড়ি বুনছেন এক নারী। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘এহনে মেয়ে বিয়া দিমু না। বিয়া দিমু ক্যা? এই যে শ্রম দিতাছি কার জন্যে? ওদের জন্যেই তো (মেয়েদের জন্যে) শ্রম দিতাছি। পড়াশোনা শিখায় উপযুক্ত বয়সে বিয়া দিমু।’ একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে এমনভাবেই বলছিলেন গৃহবধূ জুঁই আক্তার।

অভাবের সংসারে দুই মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সম্প্রতি তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁতের কাজ। বাড়িতে নিজের কেনা তাঁত মেশিনে নিয়মিত শাড়ি বুনছেন। বিক্রি করে আয় করছেন—যা তাঁর মেয়েদের বাল্যবিয়ের ঝুঁকি কমাতে বড় ভূমিকা রাখছে।

জুঁই আক্তারের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নের চর শৌলমারী গ্রামে। দিনমজুর সিরাজুলের স্ত্রী তিনি। তাঁদের ঘরে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে এবং ছোটটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ সংসারের বাস্তবতায় দুই মেয়ে ছিল বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে। সে পরিস্থিতি কাটাতেই স্বামীর পাশাপাশি নিজেও রোজগার শুরু করেছেন জুঁই। এতে দুই কিশোরী বাল্যবিবাহ থেকে বাঁচার সুযোগ পেয়েছে।

চর শৌলমারী গ্রামের ডিগ্রি কলেজের ঠিক উত্তরে থাকেন আরেক গৃহবধূ চায়না বেগম। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা এই নারীর সম্বল পাঠখড়ির তৈরি একটি মাত্র ঘর। সেই ঘরেই তিন মেয়েকে নিয়ে বাস। স্বামী মোহাম্মদ আলী ভাটাশ্রমিক। সংসারের টানাপোড়েনে টিকে থাকতে বাড়ির আঙিনায় পেঁপেসহ বিভিন্ন সবজি এবং বস্তায় আদা চাষ করেন চায়না।

চায়নার ছোট মেয়ে কোলের শিশু। বড় মেয়ে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়ে, আর মেজো মেয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সংসারে এত অভাব-অনটন থাকলেও চায়না-মোহাম্মদ আলী দম্পতি মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেননি। বরং সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে লড়ছেন দরিদ্রতার বিরুদ্ধে। বাড়তি আয় করতে তিনি এখন তাঁতের শাড়ি বুনছেন। নিজের ঘরে জায়গা না হওয়ায় শাশুড়ির ঘরের এক কোণে তাঁত মেশিন বসিয়ে কাজ করেন।

চায়না বলেন, ‘স্বামীর রোজগারে সংসার আর মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটান যায় না। আরডিআরএস থেকে তাঁত চালানের প্রশিক্ষণ নিছি। তারা মেশিন কেনার টাকাও দিছে। পুরান মেশিন কিনছি। পাশের বাড়ি থেকে শাড়ির নকশা তোলা শিখছি। অহন বড় মেয়েরে নিয়ে প্রতি দুই দিনে একটা কইরা শাড়ি তৈরি করি। মহাজন সুতা দেয়, আমরা শাড়ি তৈরি করে দিই।’

বাড়িতে তাঁত মেশিনে শাড়ি বুনছেন এক নারী। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাড়িতে তাঁত মেশিনে শাড়ি বুনছেন এক নারী। ছবি: আজকের পত্রিকা

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি শাড়ির জন্য ৬৫০ টাকা পাই। মাসে ১৮-২০টা শাড়ি বানাতে পারি। সংসারের কাজের সঙ্গে তাঁতের কাজ করে যে আয় হয়, তাতেই দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাইতে পারছি। ওরা যদ্দিন ইচ্ছা পড়বে, তারপর বিয়াশাদি।’

চর শৌলমারী গ্রামে তাঁতশিল্প এখন অনেক পরিবারের বাড়তি আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, আয় করছেন। চায়না ও জুঁই আক্তারের মতো ওই ইউনিয়নের আরও ৫০টি পরিবারের নারীরা আরডিআরএস বাংলাদেশের দেওয়া তাঁত প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সংস্থার ‘চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি)’ প্রকল্পের আওতায় তাঁরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পেয়েছেন তাঁত মেশিন কেনার আর্থিক অনুদান। সেই টাকায় শাড়ি তৈরি করে আয় করছেন। সেই আয়ে সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে পারছেন, ফলে কমছে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি।

সিএনবি প্রকল্পের তথ্যমতে, গত এক বছরে চর শৌলমারী গ্রামে ৬০ শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এদের সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এখনো অন্তত ১৮০টি পরিবার বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব পরিবারের মধ্যে থেকে ৫০ জন নারীকে তাঁত মেশিন কেনার জন্য আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। এতে পরিবারগুলো বাড়তি আয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

এ বিষয়ে সিএনবি প্রকল্পের কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী অলিক রাংসা বলেন, এনআরকে-টেলিনর্থ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা করছে। বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েশিশুদের পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এই প্রকল্পের একটি অংশ। যাতে পরিবারগুলো মেয়েশিশুদের বোঝা মনে না করে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে। এতে জেলায় বাল্যবিবাহের ও জোরপূর্বক বিয়ের হার আগের তুলনায় কমে আসছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লিটনদের ‘ফাইনাল’ ম্যাচ দিনের আলোয়

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, আটক দুই

আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিলেন রেজা কিবরিয়া, প্রার্থী হচ্ছেন কোন আসনে

আজকের রাশিফল: প্রাক্তনের মেসেজ পেয়ে আবেগে ভেসে যাবেন, কর্মক্ষেত্রে প্রশংসিত হবেন

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা: সমরাস্ত্র শিল্পের মুনাফা বেড়ে ৬৭৮ বিলিয়ন ডলার

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ