Ajker Patrika

৪৬ বছর পর মৃত ভাইকে জীবিত করার চেষ্টা

শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১৬: ২৯
৪৬ বছর পর মৃত ভাইকে জীবিত করার চেষ্টা

৪৬ বছর আগে বাড়ির সামনের পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় চার বছরের শিশু খোকন গাজীর। পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ গোলাম আহমদ গাজীর শিশুপুত্রের সেই মৃত্যুর ঘটনা স্বীকারও করেন। অথচ চার দশক পরে এসে মৃত ওই শিশুর সহোদর আব্দুস সাত্তার নিজেকে খোকন গাজী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপরতা শুরু করেছেন।

এরই মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে লিখিত আবেদন জানিয়ে নিজ নামসহ জন্ম তারিখ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন তিনি। এমনকি সন্তানদের জন্মসনদ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশনসহ স্ত্রী ও নিজ নামে জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে মৃত ভাইয়ের নাম ব্যবহার করেছেন আব্দুস সাত্তার। মূলত খোকন গাজীকে জীবিত প্রমাণের অপকৌশল হিসেবে ২০১৫ সালের পর থেকে আব্দুস সাত্তার এসব জালিয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। এমনকি তিনি দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখার সুযোগে ক্ষেত্রবিশেষ তা ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। 

আলোচিত এ ঘটনা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের। বিশেষ স্বার্থ হাসিলে প্রায় ৪৬ বছর পরে এসে আলোচিত আব্দুস  সাত্তার নিজ নাম-পরিচয়সহ জন্ম তারিখ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রটিকে আইনের আওতায় নেওয়ার জন্য স্থানীয়রা নির্বাচন কমিশন, বিভাগীয় কমিশনারসহ শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। 

জানা যায়, ১৯৭২ সালে উপজেলার শ্রীকৃষ্ণপুর মৌজায় খোকন গাজীর নামে তাঁর পিতা গোলাম আহমদ প্রায় ৩ একর জমি দান করেন। চার বছর বয়সে শিশুটির মৃত্যু হলে তিনি একই জমি নিজ মেয়েকে দানপত্র করে দেন।  ৪০ বছরের বেশি সময় পরে এসে ২০১৫ সালে আকস্মিকভাবে আব্দুস সাত্তার নিজেকে খোকন গাজী দাবি করেন। তাঁর পুরো নাম আব্দুস সাত্তার খোকন। এ সময় নিজেকে মৃত খোকন গাজী প্রমাণ করতে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ‘আব্দুস সাত্তার খোকন’ নামে নতুনভাবে নাগরিক সনদপত্র সংগ্রহ করেন। একপর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসের এক সহকারীর সহায়তায় আব্দুস সাত্তার খোকন নামে নতুন আরও একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। বিষয়টি জানাজানির পর নির্বাচন অফিসে অভিযোগ করা হলে নতুন ওই জাতীয় পরিচয়পত্র আটকে দেওয়া  হয়।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, জন্মের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিয়ের কাবিননামা, এমনকি ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সর্বত্র অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম আব্দুস সাত্তার ছিল। পরে নিজের নামের সঙ্গে খোকন গাজী সংযুক্ত করার অভিপ্রায়ে তিনি নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে নিজেকে আব্দুস সাত্তার খোকন গাজী দাবি করে পূর্বের কাগজপত্র সংশোধনের আবেদন করেন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরের জাল প্রত্যয়নপত্র তৈরি করেন। 

অভিযোগ উঠেছে, মৃত ভাইয়ের (খোকন গাজী) নামে থাকা ৩ একর সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য আব্দুস সাত্তার এমন জালিয়াতির কাণ্ড ঘটিয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দপ্তরে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করেন। এ সময় তিনি নিজেকে আব্দুস সাত্তারের পরিবর্তে আব্দুস সাত্তার খোকন এবং জন্ম তারিখ ১১ / ০৬ / ৭৭-এর পরিবর্তে ১১ / ০৬ / ৭১ বলে উল্লেখ করেন। 

আব্দুস সাত্তারের ভুয়া পরিচয়পত্রঅনুসন্ধানকালে দেখা যায়, স্ত্রীসহ নিজের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম আব্দুস সাত্তার রয়েছে। একই নামে একটি নিকাহনামা থাকা সত্ত্বেও সদ্য প্রস্তুতকৃত অপর নিকাহনামায় আব্দুস সাত্তার খোকন উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত জন্ম সনদসহ ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়নপত্র,  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির প্রত্যায়নপত্রেও আব্দুস সাত্তার খোকন উল্লেখ করা হয়েছে, যার সবগুলোই দ্বিতীয়বারের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার চেষ্টায় তাৎক্ষণিকভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রস্তুতকৃত। 

স্থানীয়রা জানান, মৃত ভাইয়ের নামে থাকা মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাতের লক্ষ্যে আব্দুস সাত্তার নাম পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০০৯ সালে ভূমি অফিস কর্তৃক জমির মালিকানা হিসাব বিবরণী তিনি আব্দুস সাত্তার নামে বুঝে নিলেও ২০১৫ সাল থেকে তিনি মৃত খোকন গাজীর নাম-পরিচয় বহনের চেষ্টা করছেন। বর্তমানে আব্দুস সাত্তার ও আব্দুস সাত্তার খোকন নামের দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র তিনি ব্যবহার করছেন বলেও তাঁদের দাবি। 

আব্দুস সাত্তারের দুই ভাই আবু ইব্রাহিম ও ওসমান গনি জানান, তাঁদের ভাই খোকন গাজী ছয় বছর বয়সে মারা যায়। তার পরও কেন এবং কী উদ্দেশ্যে তাদের অপর ছোট ভাই আব্দুস সাত্তার নিজের নামের সঙ্গে নতুন করে খোকন গাজী জুড়তে চাইছেন বলতে পারছেন না তাঁরা। 

অভিযুক্ত আব্দুস সাত্তার বলেন, জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে মারা গেলেও ওই ভাইয়ের নাম আমার মনে নেই। তবে একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন, মৃত ভাইয়ের জমি রক্ষার জন্য ভাই-বোনদের পরামর্শে তিনি খোকন গাজী হতে সম্মত হয়েছিলেন। 

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয়বার জাতীয় পরিচয়পত্র লাভের চেষ্টায় আব্দুস সাত্তার অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছেন, যে কারণে তাঁর আবেদন বাতিল করে আব্দুস সাত্তারকে তাঁর প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত