Ajker Patrika

অমঙ্গলপুরে মঙ্গল বার্তা

প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ
অমঙ্গলপুরে মঙ্গল বার্তা

সবুজের ছোঁয়া নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। সেই পথে নেই হেঁটে চলা কোনো পথিক। জল খেলা করা পুকুরে সূর্যের আলো এসে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন। কিন্তু আলোর খেলা দেখার নেই কেউ। থেকে থেকে কয়েকটি বাড়ি দেখা গেলেও নেই বাড়ির কোনো মালিক। অদ্ভুত এক স্তব্ধতা যেন আঁকড়ে ধরেছে এ গ্রামকে।

মঙ্গলপুর নামের এ গ্রামটির দেখা মিলবে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে। কোটচাঁদপুর শহর থেকে চৌগাছা সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার পথ গেলেই রাস্তার বাম পাশে গ্রামটির অবস্থান। কিন্তু ৮০ বছর ধরে মঙ্গলপুর গ্রামে দেখা নেই মঙ্গলের। এখানে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করে না। কাজ শেষে ক্লান্তি দূর করতে গাছের নিচে বসার জন্য নেই কোনো কৃষক।

তবে ৮০ বছরের অমঙ্গল বার্তা দূর করে এ গ্রামে এবার এসেছে মঙ্গলের বার্তা। এখানে আবার শুরু হয়েছে মানুষের বসবাস। গত ২০ জুন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় আট পরিবার এই গ্রামে বসবাস শুরু করেছে। পার্শ্ববর্তী বাগডাঙ্গা, পাশপাতিলা ও বলাবাড়িয়া গ্রামের আট ভূমিহীন পরিবারকে এই ঘর দেওয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেককে ঘর ও দুই শতক জমি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন।

ইউনিয়ন ভূমি অফিস বলছে, মঙ্গলপুর গ্রামটি উপজেলার ৬৬ নম্বর মঙ্গলপুর মৌজায় অবস্থিত। এই মৌজায় এ গ্রামটিই একমাত্র গ্রাম। গ্রামে ২০৬টি খতিয়ানভুক্ত জমি আছে কিন্তু সেখানে কোনো পরিবারের বসবাস ছিল না। স্থানীয় লোকজনের অনেকেই জানান, প্রায় ৮০-৮৫ বছর আগে ‘মঙ্গলপুর’ গ্রামের মানুষের মধ্যে অমঙ্গল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কলেরা বা গুটিবসন্তের মতো মহামারি রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে অনেকে মারা যায়। এ সময় প্রাণে বাঁচতে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই গ্রামটি মানুষশূন্য। 

কোটচাঁদপুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘৭০-৮০ বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যায়। এ আতঙ্কে গ্রামের মানুষ আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। তবে তারা আর ফিরে আসে না। আর কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যায়।’ পাশের গ্রাম বলাবাড়িয়ার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হিন্দুধর্মের ছিল বলে শুনেছি। গ্রামে যখন কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে তখন অনেক মানুষ মারা যায়। ওই সময় গ্রামে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের খাল, বিল, পুকুর ও কুয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। এই প্রচারের পর গ্রামের মানুষ দল বেঁধে ভারতে চলে যায়।’ তিনি আরও জানান, সর্বশেষ নেটে ঠাকুর নামের একজন মঙ্গলপুরে থাকতেন। তিনি পরবর্তী সময়ে খুন হলে গ্রামটি সম্পূর্ণ মানুষশূন্য হয়ে পড়ে।

মঙ্গলপুরে ঘর পাওয়া সবিতা দাস ও খোকন দাস বলেন, ‘আমরা ঘর ও জমি পেয়ে খুবই খুশি। তবে কথিত এই গ্রামের অমঙ্গল নিয়ে ভীত নই। এখন মানুষ আর রোগ নিয়ে ভয় পায় না। সচেতন হলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করে। ইতিমধ্যে এখানে নতুন বাসিন্দাদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এলাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম মঙ্গলপুর। কিন্তু এই গ্রামে দীর্ঘদিন মানুষের বসবাস ছিল না। জনমানবশূন্য ওই গ্রামে আজ আট পরিবারের বসবাস করছে। ধীরে ধীরে আরও বসতি গড়ে উঠবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত