Ajker Patrika

কাঁদলেন বীরাঙ্গনা জয়গুন, কাঁদালেন সবাইকে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
Thumbnail image

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সংবর্ধনা ও সম্মাননা পেলেন বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার খানম। তবে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এই সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। 

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অশ্রুভেজা চোখে একাত্তরে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া বীভৎস নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন জয়গুন নাহার। তিনি বলেন, বাবা আর ভাইদের মারতে মারতে অচেতন করে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাকে তুলে নিয়ে গেছিল। ক্যাম্পে পাঁচ ছয় মাস ধরে চারজন পাক সেনা দিন রাত নির্যাতন চালাতো। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল আমার। সুযোগ বুঝে একদিন পালিয়ে আসি সেখান থেকে। 

বীরাঙ্গনা জয়গুন জানান, যুদ্ধ শেষে ফাল্গুনে জন্ম হয় তাঁর মেয়ে নিমসানার। এরপর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। পরিবার, সমাজের নানা কটু কথা শুনে দিন পার করতে হয় মা, মেয়েকে। এভাবে ৫০টা বছর কেটেছে জয়গুনের। পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা। এখন বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষা করে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যুদ্ধদিনে জয়গুনের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে উপস্থিত অতিথিরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। 

অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা যুদ্ধ করেছি একবার, একাত্তরে আট নয় মাস। কিন্তু বীরাঙ্গনা যারা আছেন, তাঁরা যুদ্ধ করেছেন বারবার। একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, একাত্তরের পর যুদ্ধ করেছেন। এখনো তাঁরা যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। অথচ তাঁদের অবদানের জন্য কিছুই দিতে পারিনি আমরা। বীরাঙ্গনা জয়গুন আমার এখানে এত দিন ধরে চিকিৎসাধীন আছে। কিন্তু অনেক দিন ধরে আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। কারণ পাকিস্তানিরা তাঁদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে আমরা তার চেয়েও বেশি খারাপ আচরণ করেছি বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে। জয়গুন যদি আমাকে বলে আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলাদেশে আমার জন্য কী করেছেন আপনারা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মতোই দু ফোঁটা চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কী করতে পারতাম আমি? 

অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার খানমের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এরপর বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহারের সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। 

নারী প্রবর্তনার সভাপতি ফরিদা আখতার বলেন, সব সময় আমরা বলি আড়াই লাখ মা বোন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাত্র ৪১৬ জন নির্যাতিতা বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছে। এর থেকে কলঙ্কজনক আর কি হতে পারে? এটা আমাদের জন্য লজ্জা যে আড়াই লাখের মধ্যে মাত্র ৪১৬ জনকে আমরা সম্মান দিতে পেরেছি। 

বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি তাঁরা সামনে আসতে চায় না। বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় দিতে তাঁরা সংকোচ বোধ করে। এটাও আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা তাঁদের সসম্মান সামনে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারিনি। 

নারীপক্ষের সদস্য লিপি লিলিয়ান রোজারিও বলেন, ২০১১ সাল থেকে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছি আমরা। বীরাঙ্গনাদের আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা সংক্রান্ত সহায়তা দিচ্ছি। এ পর্যন্ত ৬০ জনের মতো বীরাঙ্গনাকে আমরা সহায়তা দিতে পেরেছি। কিছু শব্দবন্ধের মধ্যে আটকে না রেখে একাত্তরে নির্যাতিতারা যেন মাথা তুলে বাঁচতে পারে আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। 

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের পরিচালক বদরুল হক। তিনি বলেন, বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহারকে চিকিৎসা সেবা দিতে পেরে আমরা গর্বিত। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও বীরাঙ্গনাদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। 

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৩ নভেম্বর ব্যাক পেইন নিয়ে বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার তাদের হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তার করোনা পজিটিভ আসে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বিনা মূল্যে তাঁর চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। পাশাপাশি নারীপক্ষ সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে এই বীরাঙ্গনাকে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত