Ajker Patrika

অস্তিত্ব সংকটে গারোদের মাতৃভাষা ‘আচিক’

আনোয়ার সাদাৎ ইমরান, মধুপুর (টাঙ্গাইল) 
অস্তিত্ব সংকটে গারোদের মাতৃভাষা ‘আচিক’

বন-পাহাড়ের বাসিন্দা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ‘আচিক’ অস্তিত সংকটে পড়েছে। গারো ভাষার লেখ্যরূপ না থাকা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা আর সংখ্যাগুরু ভাষার প্রভাবের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনেস্কোর হিসেবে পৃথিবীতে ভাষা রয়েছে ৬ হাজার ৭০০টি। এর মধ্যে চিরতরে হারিয়ে গেছে ২২৯টি। ২ হাজার ৫৮০টি ভাষা বিলুপ্তির পথে। এর অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভাষা। গারোদের ভাষা ‘আচিক’ একই পথের পথিক হয়ে গেছে। 

বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক ফিলিপ গাইন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, মধুপুরের ৪৪টি গ্রামে ৪৭ হাজার ৭২৬ জন বাসিন্দার মধ্যে ১৭ হাজারের অধিক গারো সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করেন। এ হিসেবে ৬৪ দশমিক ৬১ শতাংশই বাঙালি। গারোদের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৩৯ ভাগ। 

জানা যায়, আচিক ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মধুপুর বনাঞ্চলে ২০০৮ সালে ১২টি আদিবাসী প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু হয়েছিল। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দাতা সংস্থার সহযোগিতায় বিদ্যালয়গুলো চালু করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তৎকালীন উপদেষ্টা সি এস করিম বেরীবাইদ ইউনিয়নের আদিবাসী প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়টি উদ্বোধন করেছিলেন। জিও-এনজিওর সহযোগিতা না থাকায় বিদ্যালয়গুলো টিকিয়ে রাখতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। 

গারোদের বর্ণমালার নাম ‘থকবিরিম’। ‘থকবিরিম’ অস্তিত্ব সংকটের বর্ণনা করেছেন গবেষক বাধন আরেং। তাঁর বর্ণনায় ‘হাজার বছর আগে আরুরংদি নামের একটি পাহাড়ি নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ তিব্বতগিরি এলাকায় গারো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাস করত। সে সময় শক্তিশালী বিশাল এক বহিরাগত শত্রুর দ্বারা গারোরা আক্রান্ত হয়। ভয়াবহ যুদ্ধে পশুর চামড়ায় গারো ভাষার বর্ণমালা, তাদের ইতিহাস, আইন, সামাজিক বিধিবিধান ও সাহিত্যের অনেক মূল্যবান দলিল ধ্বংস হয়ে যায়। আর একটি পৌরাণিক গল্প অনুযায়ী কলাপাতায় লেখা গারো ভাষার ‘থকবিরিম’ বা বর্ণমালা একদিন একটি গরু খেয়ে ফেলে।’ এ জন্য আচিক ভাষা প্রথম দিকেই হোঁচট খায়। 

এসব কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে ময়মনসিংহ আদিবাসী উন্নয়ন ফেডারেশনের সভাপতি অজয় এ মৃ বলেন, বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ গারো ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য গবেষণা করছেন। রোমান হরফ ব্যবহার করে আচিক ভাষা উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। 

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা গবেষক রবিখান বলেন, গারোদের পরিবারের প্রধান হল মায়েরা। মাতৃতান্ত্রিক প্রথার কারণে মায়েরা ভূ-সম্পত্তির মালিকও। অভিজাত জীবনযাপনের প্রয়োজনে এবং সংসারের হাল শক্ত করে ধরার প্রয়োজনে শহরমুখো হয়ে সংখ্যাগুরু সঙ্গে মিশে গেছে গারো নারীরা। তাঁদের অজান্তেই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে গারোদের মাতৃভাষা। 

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকেরক বলেন, মধুপুরের শালবনে আগে শুধুমাত্র গারোরাই বাস করত। তাঁরা তাদের মাতৃভাষা ‘আচিক’ ভাষায় কথা বলত। অন্য ভাষার প্রয়োজন হতো না। বর্তমানে বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে। বাংলা ভাষার মাধ্যমে পাঠ্যবই পড়ছে। আবার উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীরা ইংরেজির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে করে পারিবারিকভাবেও আচিক ভাষা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। সংখ্যাধিক্যের ভাষা হিসেবে বাংলা ও প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজির দিকে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বেশি। 

ইউজিন নকরেক আরও বলেন, আদিবাসী প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দাতা সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার পরও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। 

মধুপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গারোদের মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই সরবরাহ ও পাঠদান শুরু করেছে। তাদের ভাষার কোন লেখ্যরূপ না থাকায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে তাদের ভাষার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। 

আদিবাসীদের প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যাপারে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, চাহিদার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। চাহিদা কমে গেলে বিলুপ্ত হয়। আদিবাসী প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যাপারে আমি অবহিত নই। তবে বিদ্যালয়গুলোর ধারাবাহিকতা থাকলে অবশ্যই জাতীয়করণ হয়ে যেত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত