Ajker Patrika

ঐতিহ্যের নৌকা বাইচে প্রাণের উৎসব

ঘিওর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি
ঐতিহ্যের নৌকা বাইচে প্রাণের উৎসব

মানিকগঞ্জের নদীতে এগিয়ে চলছে বাহারী আকৃতির নৌকা। হরেক রঙের পোশাকে মাঝি-মাল্লাদের সমবেত কণ্ঠের 'হেইয়ো হেইয়ো' সারিগান। দুপাড়ে হাজার হাজার দর্শকদের উত্তেজনা। সবার উৎসুক দৃষ্টি আর মূর্হমূহ চিৎকার-করতালি। নির্মল আনন্দের খোরাক এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর।

জানা যায়, নদীর এই জলতরঙ্গের সঙ্গে মানিকগঞ্জের মানুষের মিতালি শৈশবকাল থেকে। নৌকাবাইচের এ রীতি এ অঞ্চলে অনেক প্রাচীন। মানিকগঞ্জবাসী করোনার কারণে দীর্ঘদিনের স্থবির ছিল। জীবনের এ স্থবিরতা কাটিয়ে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচে আবারও মেতে উঠেছে তারা।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাপদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতী, কান্তাবতী মানিকগঞ্জের ইতিহাস। মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যতে রয়েছে নদী ও নৌকার সরব উপস্থিতি। শত শত বছর ধরে এটি চলে আসছে। কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এসে অনেকেই প্রাচীন এই ঐতিহ্য ভুলে যেতে বসেছে। এ বিষয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন ও এগিয়ে আসতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠপোষকেরা।

এলাকার একাধিক নৌকাবাইচের মালিক জানান, বাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বা। কারণ, সরু ও লম্বা নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। বিভিন্ন আকৃতির বহু নৌকা সমবেত হলে শুরু হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান নামের নৌকা থাকে এ প্রতিযোগিতায়।

একেকটি নৌকা লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। এসব নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয়। এতে থাকে ময়ূরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব। পাশাপাশি নৌকাকে দৃষ্টিগোচর করতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতানৌকার নামকরণেও থাকে ভিন্নতা থাকে। যেমন-হারানো মানিক, গায়না তরী, সোনার চান, মায়ের দোয়া, দুই ভাই, দাদা নাতি, সোনার বাংলা, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, হাজারি তরী, আল্লাহর দান, শোকচাঁন তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফানমেইল, জয়নগর, চিলেকাটা, সোনার তরী, দীপরাজসহ অনেক নাম। দর্শকেরা দূর থেকে নৌকার অবয়ব থেকেই বলে দিতে পারে এটি কোন নৌকা।

এই মৌসুমে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় কমপক্ষে অর্ধশত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঘিওর উপজেলার কলতা কান্তাবতি নদীতে দুই’শত বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ, হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ইছামতী নদীতে, দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের সমেতপুর বিলে, শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতী নদীতে, হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ি বিল, সিংগাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুন্ডা-জাবরা এলাকায় ইছামতী নদীতে, মানিকগঞ্জ শহরের বেউথায় কালিগঙ্গা নদীতে, সদর উপজেলার বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা।

এই প্রতিযোগিতায় রং বেরঙের বাহারি নৌকা আর হাজারো উৎসুক দর্শকের ভিড়ে নদী হয়ে উঠে উৎসব মুখর। নদীর দু’পাড়ে নৌকা বাইচ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে।

জেলার ঘিওর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম টুটুল বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে সুদৃশ্য বাইচের নৌকা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, অনেক খরচের পরও শখ আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে তাদের এই আয়োজন।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাশখের বশে বাইচের নৌকা পরিচালনা করতে খরচ জোগাতে নিজের ১০ বিঘা জমি বিক্রির জনশ্রুতি রয়েছে বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের জোকা এলাকার মরহুম হাজী সবেদ ফকিরের।

এ বিষয়ে তার বংশধর মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদের নৌকার নাম ছিল হাজি সবেদ এন্টারপ্রাইজ। শুধু শৌখিনতা আর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তার দাদা জমি বিক্রি করেছিলেন।

এ বিষয়ে লোকজ ঐতিহ্য উন্নয়ন ও গবেষক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নৌকাবাইচ সমন্ধে মানিকগঞ্জের মানুষের মাঝে জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা শুরু।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাঅন্য একটি জনশ্রুতি হলো, আঠারো শতকের শুরুর দিকে গাজী পীর মেঘনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। তখন নৌকা নিয়ে ভক্তদের মাঝনদীতে শুরু হয় তোলপাড়। এতে আশপাশের সারি সারি অজস্র নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে যায়। আর এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। আবার অনেকের মতে, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়।

এ বিষয়ে হরিরামপুরের কালোই এলাকার মাল্লার সর্দার ছিলেন আব্দুল করিম বলেন, নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাঁদের গানগুলো মাল্লাদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। বাজনার তালে নৌকাবাইচে মাঝি-মাল্লারা একসুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। এতে নৌকার কোনো বইঠা ঠোকাঠুকি না করে একসঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসার শব্দে এই বইঠার এবং গানের গতি বজায় রাখেন।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাবাইচের নৌকার মাল্লা ঘিওর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের মুন্নাফ মোল্লা বলেন, নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে। যে কেউই নৌকার মাঝি হতে পারবে না। মাঝি হতে হলে তাকে একটু হৃষ্টপুষ্ট হতে হয়। ছয় মাস আগ থেকেই বাছাই করা হতো মাঝিদের। নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়।

ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান হাবিব নৌকাবাইচের স্মৃতিচারণ করে জানান, আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকাবাইচ নানা প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মেহনতি মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আনন্দের নৌকাবাইচ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত