Ajker Patrika

চটকদার বিজ্ঞাপনে চাকরির প্রস্তাব, টার্গেট নারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
চটকদার বিজ্ঞাপনে চাকরির প্রস্তাব, টার্গেট নারীরা

প্রতারণার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশীর অর্থ আত্মসাৎ, নারীদের শ্লীলতাহানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিয়েল সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আমির হামজা ওরফে সিরাজীকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১। এমন খবরে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আসেন তন্বীসহ (ছদ্মনাম) প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রতারণার শিকার তন্বী। 

তন্বী র‍্যাবের কাছে জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার তন্বী আক্তার (১৯) আর্থিক সংকটের কারণে অনলাইনে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করলে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয় রাজধানীর বসুন্ধরায়। সাক্ষাৎ শেষে জানানো হয় চাকরি পেতে হলে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এ জন্য দিতে হবে ১ হাজার টাকা। দুই দিন সময় নিয়ে ১ হাজার টাকা দেন তন্বী। এরপর পাঠানো হয় বারিধারায় প্রতিষ্ঠানটির অফিসে। সেখানে জানানো হয় তাঁকে কাজ করতে হবে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে। সময় ৮ ঘণ্টা, বেতন সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। কিন্তু চাকরিটি পেতে হলে তাঁকে দিতে হবে ৪ হাজার টাকা। আর্থিক সংকটের মধ্যেও চাকরি পেতে বাধ্য হয়ে আরও ৪ হাজার টাকা দেন তন্বী। টাকা দেওয়ার পর তন্বীকে বলা হয় প্রথম মাসে নয় হাজার টাকা দেওয়া হবে। পরের মাস থেকে সাড়ে ১৪ হাজার করা হবে। এবারও তাদের শর্তে রাজি হন তন্বী। নিয়োগের পর প্রথমে কাজ দেওয়া হয় যাত্রাবাড়ীর একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে কয়েক দিন কাজ করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তন্বী। এরপর তাঁকে বলা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে। আর সেখানে শুরু হয় তাঁর ওপর যৌন নির্যাতন। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়াসহ নানাভাবে শ্লীলতাহানি করতেন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) আমির হামজা ওরফে সিরাজী। এমন কাজের প্রতিবাদ ও সিরাজীর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রধান কার্যালয়ে থেকে তন্বীকে পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জ বন্দরে। সেখানে দায়িত্বরত অবস্থায়ও তন্বীকে কু-প্রস্তাব দিতে থাকেন সিরাজী। গত দেড় মাস ধরে কাজ করলেও সিরাজীর প্রস্তাব না মানায় দেওয়া হয়নি বেতন-ভাতা। শুধু তন্বী নয় সিরাজীর পাতা চাকরির ফাঁদে পরে তাঁর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বেতন পাননি বহু তরুণ-তরুণী। প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসত মানসিক নির্যাতন, প্রশাসনের ভয়, জরিমানাসহ নানা শাস্তি। 

সিরাজী প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরতে মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন। 

র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, সমাজের বেকার, অল্পশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারগুলোকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খিলক্ষেত থানার বনরূপা আবাসিক এলাকার রিয়েল ফোর্স সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেডের অফিসে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমির হামজা ওরফে সিরাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

এ সময় তাঁর কাছ থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা ৪টি ওয়াকিটকি সেট,৩টি ওয়াকিটকি চার্জার, ১৬টি গার্ড ইউনিফর্ম,১টি মেটাল ডিটেকটর,১টি সিগন্যাল লাইট,৬টি বেল্ট,২টি মোবাইল, ৩ জোড়া বুট এবং নগদ ৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। 

লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, ‘এক সময়ে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করলেও ২০১৭ সালে নিজেই রিয়েল ফোর্স নামে সিকিউরিটি কোম্পানি শুরু করেন সিরাজী। তাঁরা প্রথমে বিভিন্ন ছোট প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক গার্ড নিয়োগ করত। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে কোম্পানিটি লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহ করার জন্য দেশের বড় দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁরা চুক্তি করে। এরপর বিভিন্ন থার্ড পার্টি ও দালালের মাধ্যমে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের দিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করা হতো। চাকরিপ্রত্যাশীদের সুপারভাইজার হিসেবে আট ঘণ্টা ডিউটি এবং মাসিক ১৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতনের অফার দেওয়া হয়।’ 

আব্দুল্লাহ আল মোমেন আরও বলেন, ‘চাকরিপ্রত্যাশী ভুক্তভোগী ৬ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ র‍্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন যে—তাঁরা অনলাইনে কথাবার্তা বলার সময় কোনো ধরনের টাকা পয়সা লাগবে না বলে জানতে পারে। লোভনীয় চাকরির অফারে তাঁরা এই চক্রের খপ্পরে পড়ে। পরে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তাদের ১২ ঘণ্টা সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি এবং ডে-নাইট হিসেবে একসঙ্গে ডিউটি করানো হলেও বেতন দেওয়া হয়নি। এমনকি ঈদের সময়েও তাঁরা কোনো ধরনের টাকা পয়সা পাননি। এর প্রতিবাদ করলে মানসিক নির্যাতন চালানো, প্রশাসনের ভয় দেখানো, জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণের ভয় দেখানোসহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো।’ 

নারী ভুক্তভোগীরা জানান, চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর চক্রের এমডি আমির হামজা মেয়েদের বিভিন্ন সময় কুপ্রস্তাব দেওয়াসহ প্রায়ই শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে থাকে। যারা তার প্রস্তাবে রাজি হয় তাদের সে অফিসে ডিউটি দেওয়া, বিয়ের প্রলোভন দেখানো এবং নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো। যারা তার প্রস্তাবে রাজি হতো না সেসব মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, মানসিক নির্যাতন, জোর করে আটকে রাখা এবং তাদের দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করানো হতো। 

আমির হামজার বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি চুরির মামলা রয়েছে। পাশাপাশি ২৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে এই কোম্পানির এক সিকিউরিটি গার্ড আনোয়ার হোসেনের মরদেহ পাওয়া যায়। সে সময় আমির হামজা আত্মগোপনে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত