Ajker Patrika

হাত বদলেই সবজির দাম ৩ গুণ!

নুরুল আমীন রবীন, শরীয়তপুর
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১৩: ০৮
হাত বদলেই সবজির দাম ৩ গুণ!

শরীয়তপুরের জাজিরার মিরাশার চাষি বাজারে কৃষকের উৎপাদিত ফসল সরাসরি বিক্রি করা হয়। জেলার অন্যতম বৃহৎ এই পাইকারি সবজির বাজারে প্রতি কেজি মিষ্টি কুমড়া ৬ থেকে ৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ওই মিষ্টি কুমড়াই পাইকারি বাজার থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। শুধু মিষ্টি কুমড়া নয়, কৃষকের উৎপাদিত প্রতিটি সবজিই এভাবে দুই থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কৃষকদের থেকে সবজি কেনার পর মধ্যস্বত্বভোগীদের তিন-চার দফা হাতবদলের কারণে দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। 

জেলা শহরসহ আশপাশের অন্তত ১২টি সবজির বাজার ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। কৃষক পর্যায়ে দাম কম থাকলেও ভোক্তা পর্যায়ে কয়েক গুণ বেশি দামে ক্রয় করতে হচ্ছে সবজি। 

এ বিষয়ে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতা ও ক্রেতারা জানান, কৃষকদের উৎপাদিত সবজি সঠিক দামে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির জন্য ২০০৭ সালে ঢাকা-শরীয়তপুর সড়কের পাশে জাজিরার মিরাশার এলাকায় একটি চাষি বাজার স্থাপন করা হয়। জাজিরা ও নড়িয়ার স্থানীয় কৃষকেরা ওই বাজারে তাঁদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। ওই চাষি বাজার থেকে ঢাকা, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবজি সংগ্রহ করেন। 

মিরাশার চাষি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি কেজি বেগুন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ১১ থেকে ১৩, টমেটো ১২ থেকে ১৫, কাঁচামরিচ ৩০ থেকে ৩৫, উস্তা ১৮ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ওই বাজার থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরের জেলা শহরের পালং বাজার, আঙ্গারিয়া বাজার, কোর্ট বাজারসহ আশপাশের বাজারে ওই সব সবজি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে। প্রতিটি বাজারেই বেগুন ৬০ থেকে ৭০, ঢ্যাঁড়স ৩০ থেকে ৪০, টমেটো ২৫ থেকে ৩০, কাঁচামরিচ ৭০ থেকে ৮০, উস্তা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পাইকারি বাজারে শসা ১৫ টাকা দরে বিক্রি করা হলেও খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। ধুন্দল ও ঝিঙে পাইকারি বাজারে ৩০ টাকা, খুচরা বাজারে তা ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা কলা প্রতি হালি ১০ থেকে ১২ টাকা, খুচরা বাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। ডাঁটা প্রতি আঁটি ৫ টাকা, খুচরা বাজারে তা ২৫ টাকা। ধনেপাতা প্রতি কেজি ৮০ টাকা, খুচরা বাজারে তা বিক্রি করা হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে। 

জাজিরার মুলনা ইউনিয়নের ডুবিসায়বর গ্রামের কৃষক ইউনুস মাদবর বলেন, ‘আড়াই বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছি। মিরাশার চাষি বাজারে ৬ টাকা কেজি দরে ১৩৫ কেজি কুমড়া বিক্রি করেছি। এতে উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন খরচ উঠবে না। এভাবেই বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে সবজি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে।’

নাওডোবা ইউনিয়নের মাদবরকান্দি গ্রামের সুরুজ মাদবর ৩৫ টাকা কেজি দরে ১২০ কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি করে হতাশা প্রকাশ করেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঋণের টাকায় ফসল ফলাই। বিক্রির সময় কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের ওই সবজিই হাটবাজারে দুই-তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করতে দেখে হতাশ হই। আসলে আমাদের বিষয়ে ভাবার কেউ নাই।’ 

জেলা শহরের পালং বাজারে সবজি কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শান্তিনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সবুজ বেপারী। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অথচ পাইকারি বাজারে এসব সবজির দাম ২ থেকে ৩ গুণ কম। এতে করে কৃষককে ঠকানো হচ্ছে। মাঝখান থেকে সিন্ডিকেট করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি মনিটরিং করার দাবি জানাচ্ছি।’

মিরাশার চাষি বাজারের সভাপতি আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, কৃষকেরা তাঁদের সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। সেখান থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা সবজি সংগ্রহ করেন। পরে পাইকাররা সেই সবজি বিভিন্ন হাটবাজারের আড়তে বিক্রি করেন। আড়ত থেকে খুচরা বিক্রেতারা তা কিনে নিয়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। এভাবে কয়েক দফা হাতবদলের কারণে সবজির দাম দুই-তিন গুণ বেড়ে যায়। 

এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা ইউসূফ হোসেন বলেন, ‘কৃষকের সঙ্গে সরাসরি ভোক্তার সংযোগ নেই। কৃষকের পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে অন্তত চারটি হাত বদল হয়। তাই ধাপে ধাপে সবজির দাম বাড়ে। কৃষকের সঙ্গে খুচরা বিক্রেতার সংযোগ স্থাপনের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। তাহলে কৃষকেরাও ন্যায্য মূল্য পাবেন, আবার ভোক্তারাও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন।’ 

শরীয়তপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুজন কাজী বলেন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রির সামঞ্জস্য থাকতে হবে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। 

সহকারী পরিচালক আরও বলেন, বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অবৈধ উপায়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত