Ajker Patrika

কখনো গায়ে হাত না তোলা বাবা কীভাবে দুই সন্তানের গলা কাটলেন!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
Thumbnail image
শিশু রোহান মোল্লা বিজয় ও মুসা মোল্লা। ছবি: সংগৃহীত

কেঁদে কেঁদে বাবার কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল তিন বছরের শিশু মুসা; কিন্তু বাবা আহাদ মোল্লা থামেননি। গলা কেটে তিনি হত্যা করেন মুসাকে। এর আগে বড় ছেলে সাত বছরের রোহানকে একইভাবে হত্যা করেন আহাদ। তারপর নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এই ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর পল্লবীর এক বাসায়।

পেশায় বাসাবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আহাদ মোল্লা কেন নিতান্ত শিশু সন্তানদের এভাবে হত্যা করলেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাঁর স্ত্রী জানিয়েছেন, ঋণগ্রস্ত থাকার কারণে তিনি মানসিক চাপে ছিলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

রাজধানীর পল্লবীর শেষ সীমানা বাইগারটেক। অনুন্নত এলাকাটিতে এখনো জনবসতি কম। নতুন নতুন বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। রাস্তাঘাট ভালো নয়। ইসিবি চত্বর দিয়ে বালুঘাট ছাড়িয়ে উত্তরে আরও তিন-চার কিলোমিটার এগোলো বাইগারটেক। এলাকাটির আগে বেপারী মার্কেট। এই মার্কেটের পাশেই ব্যবসায়ী নাসির হোসেনের তিনতলা বাড়ির নিচতলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন আহাদ মোল্লা। সেখানেই দুই সন্তান রোহান মোল্লা বিজয় ও মুসা মোল্লাকে হত্যা করেছেন তিনি। আহাদ মোল্লার স্ত্রী রোজিনা আক্তার এলাকার মেসে রান্নার কাজ করেন।

গতকাল দুপুরে বাইগারটেক গিয়ে দেখা যায়, নাসির হোসেনের বাড়িটি ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ইউনিট আলামত সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। ভিড় ঠেলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, দুই কক্ষের ফ্ল্যাটের সামনের কক্ষে একটি খাটে বসে আছেন নির্বাক মা রোজিনা আক্তার। তাঁর পাশে বৃদ্ধ বাবা ও মা বসা। তাঁরা গত সোমবার মেয়ের বাসায় বেড়াতে আসেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁরাও বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কেন এমন ঘটনা ঘটল, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। বাসার অন্য কক্ষের বিছানার চাদর, বালিশ রক্তাক্ত। তাতে পড়ে আছে একটি ছুরি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রোজিনা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, গতকাল শনিবার ভোরে তাঁর স্বামী আহাদ মোল্লা রাতভর পাহারার কাজ থেকে বাসায় ফেরেন। সকাল ৯টার দিকে রোজিনা তাঁর বেড়াতে আসা বৃদ্ধ মাকে নিয়ে মেসে রান্নার কাজে রওনা দেন। এ সময় তাঁর স্বামী দুই ছেলেকে বাসায় রেখে যেতে বলেন। এমনিতে রোজিনা প্রতিদিনই মেসের কাজে যাওয়ার সময় দুই ছেলেকে নিয়ে যান। কিন্তু গতকাল স্বামীর কথায় এবং বাচ্চাদের নানা বাসায় আছেন ভেবে ছেলেদের রেখেই কাজে যান। মেসে পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁর কাছে ফোনে দুই ছেলের মৃত্যুর ভয়াবহ খবরটি যায়। দৌড়ে বাসায় এসে ঘটনা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি।

ঘটনার সময় শিশুদের সত্তরোর্ধ্ব নানা জাবেদ আলী পাশের ঘরেই ছিলেন। তিনি নিজে অসুস্থ। সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না। জাবেদ আলী বলেন, ‘পাশের ঘরেই দুই ছেলেকে নিয়ে ছিল আহাদ। আমি হঠাৎ কান্নার শব্দ পাই। ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “বাবা মাইরো না, বাবা মাইরো না। আর করবো না।” তিনি তখনো বুঝতে পারেননি, আহাদ নিজের ছেলেদের এভাবে হত্যা করছে।’ জাবেদ আলী বলেন, বিছানা থেকে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের ঘরে যেতে তাঁর দুই-তিন মিনিট সময় লাগে। গিয়ে দেখেন, দুই নাতির গলাকাটা দেহ বিছানায় ফেলে রাখা। আহাদ নিজেও বিছানায় শোয়া, রক্তাক্ত। এরপর তিনি চিৎকার দিয়ে রাস্তায় যান। মানুষজন ডাকেন। লোকজন তখন পুলিশে খবর দেয়।

আহাদ মোল্লার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। তাঁর স্ত্রী রোজিনা বেগমের বাড়ি নেত্রকোনা। আহাদের এটি তৃতীয় এবং রোজিনার দ্বিতীয় বিয়ে। রোজিনা বলেন, আহাদের অনেক টাকা ঋণ আছে। পাওনাদারেরা চাপ দিলে তিনি প্রায়ই তাঁর কাছে টাকা চাইতেন। ঋণের চাপে তিনি ছেলেদের হত্যা করে থাকতে পারেন। তবে গত দু-এক দিনে তাঁদের কোনো ঝগড়া হয়নি।

দুই ছেলেকে হত্যার আগে বাসার পাশের দোকান থেকে রুটি ও ফলের রস (জুস) এনে খাওয়ান আহাদ। প্রতিবেশী তাহমিনা নামের এক নারী জানিয়েছেন, সন্তানদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। কখনো মারধর করতে দেখেননি।

দুই মাস ধরে বাড়িটিতে ভাড়ায় থাকেন আহাদ ও রোজিনা দম্পতি। বাড়িওয়ালা নাসির বলেন, ‘আহাদ তিনটা বিয়ে করেছে, তার পারিবারিক সমস্যা রয়েছে বলে জেনেছি। তবে কেন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা জানা যায়নি।’

গুরুতর আহত আহাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছে। ওই বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শেখ আব্দুল্লাহ মামুন জানান, তাঁর শ্বাসনালি কেটে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক।

হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে আহাদকে। দুই শিশুর লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে পল্লবী থানা-পুলিশ। পল্লবী থানার ওসি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো জানা যায়নি। অভিযুক্ত আহাদ মোল্লা নিজেও গুরুতর আহত। তিনি সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নিহত শিশুদের মা রোজিনা এ ঘটনায় মামলা করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত