Ajker Patrika

ঝরে পড়া শিশুরা শ্রমবাজারে

শিপ্ত বড়ুয়া, রামু (কক্সবাজার) 
Thumbnail image

কক্সবাজারের রামুর বাইপাসের সাহাব উদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছিল ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। উপজেলার রাজারকুলে তার বাড়ি। করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ হওয়ায় কাজে যোগ দিয়েছে সে। বিদ্যালয় খুললে আবারও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার।

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা এই কিশোর বলল, ‘অনেক দিন স্কুল বন্ধ হওয়ায় কাজে এসেছি। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। ছোটকাল থেকে হাতের একটা কাজ শিখে রাখলে ভালো। বড় হয়ে নিজে একটা ওয়ার্কশপ খুলতে পারব।’

এ প্রতিবেদন তৈরি করার সময় দেখা যায়, সে গ্রান্ডিং মেশিন চালাচ্ছে। একটি লোহার পাইপ কাটার যে কাজ করছিল, যেখান থেকে অতি সূক্ষ্ম আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল। যদিও চোখের সুরক্ষার জন্য কোনো চশমা বা সুরক্ষা সামগ্রী ছিল না তার চোখে।

কোনোপ্রকার সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্কশপে এভাবে কাজ করছে বহু শিশু-কিশোর। গাড়ি মেরামতের দোকানগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে শিশুশ্রম। স্বল্পমূল্যে কাজ করাতে পারেন বলে মালিকেরাও তাদের কাজে নিয়োগ দিতে বেশ আগ্রহী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চৌমুহনীর এক গ্রিল ওয়ার্কশপের মালিক বলেন, শিশুদের কাজে নিয়োগ দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে কাজ শেখার ইচ্ছাটা তাদের মধ্যে প্রবল এবং কঠোর পরিশ্রম করে তারা। তা ছাড়া বেতন বলতে কিছুই দিতে হয় না। দুবেলা খাবার আর ৫০ থেকে ১০০ টাকা নাশতার খরচ দিয়েই কাজ করানো যায়।

দেখা গেছে, উপজেলার বেশির ভাগ ওয়ার্কশপে গ্রান্ডিং মেশিন, ড্রিল মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিচ্ছে শিশুরা। যদিও অধিকাংশ ওয়ার্কশপ মালিকেরা শ্রমের বিনিময়ে শিশু-কিশোরদের সঠিক পারিশ্রমিক দেন না। পাশাপাশি কর্মঘণ্টারও কোনো ঠিক–ঠিকানা নেই।

সূত্র বলছে, করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি আয়ের জন্য নেমেছে স্কুল-কলেজের বহু শিক্ষার্থী। যাঁরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন, তাঁরা ছাত্রজীবনে আর ফিরবেন কিনা তা নিয়েও আছে সংশয়।

পূর্ব রাজারকুল গ্রামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীও বাবার পাশাপাশি হাল ধরেছে পরিবারের। কিস্তিতে একটি মিনি টমটম কিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন চালাচ্ছে।

সে আজকের পত্রিকাকে বলে, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় তেমন কোন কিছুই করা হচ্ছিল না। বেকার বসে ছিলাম ভাবলাম করোনার এই সময়ে স্কুল যেহেতু বন্ধ কিছু একটা কাজ করা দরকার। সহজ হিসেবে মিনি টমটম চালিয়ে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় করছি। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারছি, এটাই আনন্দ।’

তবে ওয়ার্কশপ কিংবা গাড়ি চালনায় শিশু-কিশোরদের উপস্থিতিকে ভালো চোখে দেখছেন না স্থানীয় অনেক অভিভাবক ও শিশু-কিশোর সংগঠনের নেতারা। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িয়ে তারা আবারও লেখাপড়ায় ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।

এ বিষয়ে দরিয়া খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক সজল কান্তি দে বলেন, করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে কি পরিমাণে শিশু-কিশোর লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়েছে তার সঠিক হিসেব নেই। দ্রুত সরকারের স্কুল-কলেজ খোলা বা নিয়মিত পাঠদানের অন্য কোনো পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ শ্রম আইনে ঝুঁকিপূর্ণ মেশিন চালনা এবং নির্দিষ্ট কিছু কাজে শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিশোরদের শ্রম বিক্রিতেও রয়েছে নানান সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা যার অধিকাংশ মানছে না ছোট কল-কারখানা ও ওয়ার্কশপগুলো।

স্থানীয় হাজী এম এ কালাম সরকারি কলেজের অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ায় যে সিলেবাসে লেখাপড়া হওয়ার কথা তা আর হচ্ছে না। প্রায় দুই বছরের এই ধাক্কা ভীষণ ক্ষতিকর। যে কারণে অনেক ঘাটতি থেকে যাবে। পরবর্তীতে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর হবে।’

রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ এই লকডাউনে শিক্ষার যে কি ক্ষতি হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছেন ইন্টারনেট থেকে কপি করে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী রাজমিস্ত্রির কাজ পর্যন্ত করছে। স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়ে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিবে আশা রাখি।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত