Ajker Patrika

বন-সাগর ধ্বংসের ‘রাজা’

  • ইয়ার্ডের জন্য জমি ইজারা না দিতে বারবার আপত্তি জানায় বন বিভাগ।
  • জেলা প্রশাসন একই বনভূমি আগে দুবার ইজারা দেয় রাজা কাশেমকে।
  • বনের গাছ কেটে সাবাড়, বালু তুলে দখল করেছেন সাগর।
নিজস্ব প্রতিবেদক ,চট্টগ্রাম
আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ৫৯
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের তুলাতলী এলাকা জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব জমি মূলত সরকারের বনাঞ্চল। কিন্তু গাছ কেটে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। পাশাপাশি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সাগর থেকে বালু তুলে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। আজকের পত্রিকা
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের তুলাতলী এলাকা জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব জমি মূলত সরকারের বনাঞ্চল। কিন্তু গাছ কেটে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। পাশাপাশি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সাগর থেকে বালু তুলে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। আজকের পত্রিকা

শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণ করতে এবার ২০ একর বনভূমি বরাদ্দ চেয়েছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আবুল কাশেম (রাজা কাশেম)। তবে বরাদ্দ পাওয়ার আগেই বনাঞ্চলের গাছ সাবাড় করে ইয়ার্ডের জন্য দোতলা ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। সাগর থেকে বালু তুলে সাগরই ভরাট করেছেন। সম্প্রসারণ করেছেন ইয়ার্ড।

এর আগে একই জায়গায় দুবার শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণ করতে গিয়ে বন বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তৎপরতায় ব্যর্থ হন কাশেম।

আবুল কাশেম প্রভাব খাটিয়ে বারবার সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ নৌঘাট ইজারা নিতেন। এ জন্য তিনি ঘাটের রাজা বা রাজা কাশেম হিসেবে পরিচিতি পান।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের তথ্য বলছে, শিপ ব্রেকিং (জাহাজ ভাঙার) ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর মৌজায় ২০ একর জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছেন কোহিনূর আক্তার। বেঙ্গল ওশান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হিসেবে আবেদন করা কোহিনূর সীতাকুণ্ডের বিতর্কিত শিপ ব্রেকার রাজা কাশেমের স্ত্রী। গত ৬ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবর এই আবেদন করা হয়।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বরাদ্দের জন্য আবেদন করা জমি সীতাকুণ্ডের সলিমপুর মৌজা উল্লেখ করলেও তা প্রকৃতপক্ষে তুলাতলী মৌজায়; যা জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলের বাইরের বনভূমি। একই মৌজায় এর আগে দুবার জেলা প্রশাসন জমি বরাদ্দ দিলেও বন বিভাগের আপত্তির মুখে সরে আসতে হয়েছে। বনভূমি বরাদ্দ না দিতে এবারও তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

এদিকে বেঙ্গল ওশানের আবেদনের পর ওই বনভূমি ইজারা না দিতে ৮ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছে বেলা।

জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ ও বেলার তথ্য অনুযায়ী, বেঙ্গল ওশান এন্টারপ্রাইজের নামে বরাদ্দ চাওয়া একই ব্যক্তি একই জমি আগে কোহিনূর স্টিল ও বিবিসি স্টিল নামে বরাদ্দ নিয়েছিলেন। বরাদ্দ চাওয়া জমিগুলো জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলে অর্থাৎ সলিমপুর মৌজায় নয়। প্রকৃতপক্ষে জমিগুলো তুলাতলী মৌজায়, যা বনভূমির অন্তর্ভুক্ত।

এই জমি ইজারা না দিতে বারবার আপত্তি জানিয়ে আসছিল বন বিভাগ। কিন্তু আপত্তি উপেক্ষা করে তখনকার জেলা প্রশাসকেরা একই ভূমি দুবার রাজা কাশেমকে ইজারা দিয়েছিলেন।

প্রথম ও দ্বিতীয়বার বরাদ্দ নিয়ে কাশেম সেখানে দ্বিতল ভবন গড়ে তোলেন। কিন্তু ইজারা বাতিল হওয়ার পর তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কাশেমের প্রতিষ্ঠান তা মেরামত করে এবং বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবার আবেদন করে।

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, তৃতীয়বার বরাদ্দ পাওয়ার আবেদন করেই সেখানে গাছ কাটা হচ্ছে। সাগর থেকে ড্রেজিংয়ের (খনন) মাধ্যমে বালু তুলে সমুদ্র ভরাট করা হচ্ছে ইয়ার্ড সম্প্রসারণের জন্য।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রথম ৭ দশমিক ১০ একর ভূমি শিপইয়ার্ডের জন্য ইজারা পায় কাশেমের বিবিসি স্টিল। কিন্তু তুলাতলী মৌজাটি বনাঞ্চলঘেরা হওয়ায় বেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই ইজারা বাতিল করেন উচ্চ আদালত। বিবিসির ইজারা বাতিল হওয়ার পর কাশেম তাঁর স্ত্রী কোহিনূরের নামে নতুন করে একই জমি ইজারার জন্য আবেদন করেন। ২০২২ সালে দ্বিতীয় দফায় একই মৌজা থেকে ৫ একর জমি ইজারা দেওয়া হয় কোহিনূর স্টিলকে।

তখন আদেশ উপেক্ষা করে জমি ইজারা দেওয়ায় আদালত অবমাননার মামলা করে বেলা। ২০২৩ সালের ১ জুন দ্বিতীয়বার ইজারা চুক্তি বাতিল করে জেলা প্রশাসন।

তখন ইজারা বাতিলের নথিতে জেলা প্রশাসন উল্লেখ করে, ইজারাদার গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করেছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার তুলাতলী, দক্ষিণ সলিমপুর, চর বাঁশবাড়িয়া এবং বোয়ালিয়া মৌজা অথবা সমুদ্র উপকূলবর্তী অন্য কোনো স্থানে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপন করা যাবে না।

ইজারাদার একসনা ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে শিল্পাঞ্চলবহির্ভূত তুলাতলী মৌজায় ১ নম্বর খাস খতিয়ানের জমি অবৈধভাবে দখল করে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছেন। তাই কোহিনূর স্টিলের একসনা ইজারা বাতিল করা হয়েছে।

কিন্তু ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ বিতর্কিত সেই জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের ইজারা পুনর্বহালের আদেশ দেয় বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়। এ পর্যায়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করে বেলা। এ মামলায় অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) গত বছরের ৯ জুলাই উচ্চ আদালতে হাজির হয়ে ইজারা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে মর্মে মৌখিকভাবে আদালতকে অবহিত করেন।

বেলার আইনজীবী এস হাসানুল বান্না বলেন, আদালতের সুস্পষ্ট ও ধারাবাহিক নির্দেশনা এবং আইনি বিধিনিষেধ থাকায় উত্তর সলিমপুর মৌজার প্রজ্ঞাপিত বনভূমি জাহাজভাঙা ইয়ার্ড নির্মাণের বা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ইজারা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ওই জমি ইজারা প্রদান থেকে বিরত থাকতে জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসক থেকে জমি ইজারা, বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ, কলকারখানা অধিদপ্তর ও বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই এসআরএফপির (শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান) অনুমোদনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বেঙ্গল ওশান এন্টারপ্রাইজ ও ইমিরাতি ওয়ান এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি।

মন্ত্রণালয় আবেদন দুটি নাকচ করে প্রতিষ্ঠান দুটির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থার মতামত জানতে চেয়েছে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘বেঙ্গল ওশান ও ইমিরাতি ওয়ান প্রতিষ্ঠান দুটি সলিমপুর এলাকায় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিধন করে ইয়ার্ড স্থাপন করছে বলে আমরা জেনেছি। প্রতিষ্ঠান দুটি বিএসবিএর সদস্যভুক্ত নয় বিধায় তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অ্যাসোসিয়েশন অবহিত নয় এবং এর দায়ভারও অ্যাসোসিয়েশনের নয়।’

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেঙ্গল ওশান ও ইমিরাতি ওয়ান নামের দুটি প্রতিষ্ঠান সীতাকুণ্ডে জমি ইজারার জন্য আবেদন করেছে। তবে ওই জমিতে বনাঞ্চল থাকায় এবং বনাঞ্চল ধ্বংস করায় আগের সব ধরনের ইজারা অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। শিগগির ওই প্রতিষ্ঠান-ইয়ার্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এই বিষয়ে কথা বলার জন্য রাজা কাশেমের মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাঁর স্ত্রী কোহিনূর আক্তারকেও ফোন করা হয়। কিন্তু তিনিও রিসিভ করেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিক বলেন, ইমিরাতি ওয়ান এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি নামে জমি ইজারার জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠানটি চীনের। এ প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ কোটি টাকার বিনিময়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন (বিএস খতিয়ানভুক্ত) প্রায় আড়াই একর এবং ২০ একরের বেশি বনের জায়গা দখল করে দিয়েছেন রাজা কাশেম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত