Ajker Patrika

দুর্গম থানচির গ্রামে গ্রামে ম্যালেরিয়া

থানচি (বান্দরবান) প্রতিনিধি
আপডেট : ১০ জুন ২০২২, ২০: ৩২
Thumbnail image

বান্দরবানের থানচি উপজেলার গ্রামে গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথাসহ নানা উপসর্গের রোগী। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে আগাম বৃষ্টির শুরু থেকেই ম্যালেরিয়ার রোগী বাড়ছে। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা হওয়ায় উপজেলা সদরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনেকে যেতে পারছে না। অধিকাংশই কাছাকাছি হাট-বাজারের ফার্মেসি থেকে জ্বরের ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্র্যাক দুই সপ্তাহ যাবৎ ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট ও ওষুধ দিলেও তা অপ্রতুল হওয়ায় প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসছে না। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, দুর্গম গ্রামগুলোয় বৃষ্টি শুরু হতেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে ডায়রিয়াও দেখা দিচ্ছে। গ্রামে গ্রামে ১০-১২ জন করে ম্যালেরিয়া ও জ্বরের রোগী রয়েছে। গত পাঁচ দিনে শিশুসহ ১৭ জন স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছে। বেশি দুর্গম অঞ্চল থেকে মানুষ হাসপাতালে আসতে পারছে না। 
 
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মিডওয়াইফ নিলুফা ইয়াজমিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, গত ৫ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ১৭ জন ম্যালেরিয়ার রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে সাতজন বাড়িতে চলে গেছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই শিশু ও কিশোর। নিলুফা বলেন, ‘পাহাড়ে এ সময় অর্থাৎ বৃষ্টি হলে মশার উপদ্রব বাড়ে। ঘরের আঙিনায় পানি, ময়লা-আবর্জনা জমা থাকলে মশার উপদ্রব বেশি হয়। সব সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।’ 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ম্যালেরিয়ার রোগী প্রদীপ ত্রিপুরা (৫০)। রেমাক্রী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুভাষ চন্দ্রপাড়ার বাসিন্দা তিনি। বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ঘরে ঘরে জ্বর। জ্বর পরীক্ষা করার যন্ত্র নেই, স্বাস্থ্যকর্মীও নেই। আগে তো এনজিও কর্মী ছিল, এখন তা-ও নেই। অনেকে স্থানীয় হাটবাজার থেকে জ্বরের ওষুধ কিনে খেয়ে সুস্থ হয়ে যায়। আমিও ওষুধ খেয়েছি, কিন্তু ভালো না হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে গতকাল হাসপাতালে এসেছি। চিকিৎসক-নার্সরা পরীক্ষা করে দেখে ম্যালেরিয়া জ্বর।’ 

প্রদীপ বলেন, ‘দুর্গম রেমাক্রী ইউনিয়নের ছোট মদক থেকে থানচি পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত বোটের ভাড়া অনেক। রোগী হলে রিজার্ভ নিতে হয়। বোটের ভাড়া গুনতে হয় ৩ হাজার টাকা। সেই সামর্থ্য সবার নেই।’ 

থানচি সদর ইউনিয়নের চাইঞানপাড়ার বাসিন্দা য়ইপুং ম্রো কারবারি (৫৬)। তিনিও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি। এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। বিছানায় শোয়া অবস্থায় তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় প্রায় সব পরিবারের দু-একজন জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথায় আক্রান্ত। ফার্মেসি থেকে ওষুধ খেয়ে কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জানতে পারি আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে। এখন সামান্য সুস্থ বোধ করছি।’ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ত্যক্ষ্যংপাড়ার বাসিন্দা চিংক্যনু মারমাও (২৭) বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। 

জানতে চাইলে রেমাক্রী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মেম্বার বিদ্রজয় ত্রিপুরা বলেন, ‘ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, সঙ্গে ডায়রিয়া। গত বুধবার মেনতাংপাড়ার মেনতাং ম্রো কারবারি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমি এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।’ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ইমা চন্দ্র ত্রিপুরাও একই তথ্য জানান। 

চিকিৎসাসেবার বিষয়ে জানতে চাইলে মেম্বার বিদ্রজয় বলেন, ‘ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন কেউ। স্বাস্থ্যকর্মী, ব্র্যাকের কর্মী থেকে কিছু সহযোগিতা পাচ্ছে। তবে বেশি মানুষ ও দুর্গম এলাকার কারণে এখানে স্বাস্থ্য ও পাড়াকর্মী অপ্রতুল।’ 

এ ব্যাপারে ব্র্যাকের মাঠ সংগঠক অর্পণ চাকমা বলেন, ‘ব্র্যাকের উপজেলা সদর ছাড়াও বলিপাড়া ইউনিয়নের একটি, রেমাক্রী ইউনিয়নের দুটি শাখা অফিস রয়েছে। সেখানে মোট আটজন কর্মী সার্বক্ষণিক ম্যালেরিয়ার ওষুধ, পরীক্ষার কিট ও মশারি সরবরাহ করছেন। উপজেলা সদরে মোট সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।’ 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘উপজেলায় ছোট-বড় ২৪৫টি গ্রাম রয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের তথ্যমতে, জনসংখ্যা ২৮ হাজার ৭৫০। দুর্গম হওয়ায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ হেঁটে যেতে হয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তবু সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’ 

যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মশারি, ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট, প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করছে। স্বল্পতা ছিল। স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর গতকাল চাহিদা অনুযায়ী ওষুধপত্র এসে পৌঁছেছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেছেন, পাড়ায় পাড়ায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। গতকালও টিম পাঠিয়েছি। আরও শক্তিশালী টিম আগামীকাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ, কিট, মশারি পাঠানো হবে।’ 

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে যথাযথ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানচিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত