Ajker Patrika

জীবনরক্ষার সামগ্রী ছাড়াই বিপজ্জনক ভ্রমণে পর্যটক

  • নিয়ম না মানায় আনন্দের ভ্রমণ বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • পাহাড়ের রাস্তা ও পরিবেশ সম্পর্কে অবগত না থাকায় ঘটে দুর্ঘটনা।
আলীকদম সংবাদদাতাবান্দরবান প্রতিনিধি
জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী ছাড়াই বান্দরবানের আলীকদমে একটি পাহাড়ি ঝিরিতে পর্যটকেরা। সম্প্রতি তোলা। 	ছবি: সংগৃহীত
জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী ছাড়াই বান্দরবানের আলীকদমে একটি পাহাড়ি ঝিরিতে পর্যটকেরা। সম্প্রতি তোলা। ছবি: সংগৃহীত

পাহাড় ভ্রমণে পর্যটকদের মানতে হয় নানা নির্দেশনা। সঙ্গে জীবনরক্ষাকারী সামগ্রীর পাশাপাশি রাখতে হয় অভিজ্ঞ গাইড। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে ঘর থেকে বের হওয়ার দায়িত্ব সত্ত্বেও অনেকে তা না মেনেই পরিবার নিয়ে বের হন। এতে তাঁরা নিজেদের বিপদই ডেকে আনছেন, অনেক সময় হারাচ্ছেন প্রাণ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিয়ম না মানায় আনন্দের ভ্রমণ অনেক সময় বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সবার এসব নিয়ম মেনে পাহাড় ভ্রমণে যাওয়া উচিত।

জানা যায়, বান্দরবানের রুমায় ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর থেকে প্রথম পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মাঝে কিছুদিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও গত বছর পুরো জেলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এক মাস পর গত ৬ নভেম্বর থেকে জেলা সদর, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়িতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করায় লামা, আলীকদমে পর্যটকদের আনাগোনা তুলনামূলক বহুগুণে বেড়েছে।

আলীকদম উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় মাসে ৬০০ থেকে ১,২০০ জন পর্যটক ঘুরতে আসে। সরকারি বন্ধে তা দ্বিগুণ হয়। বর্ষায় পাহাড়ের বিভিন্ন ঝিরি ও খাদগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়। এ সময় অভিজ্ঞ ট্রাভেল গাইডলাইন না মানলে মুখোমুখি হতে হয় দুর্ঘটনার। অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

চট্টগ্রাম থেকে আলীকদমে ঘুরতে আসা উৎপল বড়ুয়া বলেন, আলীকদমে গভীরে রাস্তা ও পরিবেশ সম্পর্কে অবগত না থাকায় পর্যটকেরা জীবনরক্ষকারী সামগ্রী নিয়ে আসেন না। এমনকি কোনো গাইডও তাঁদের কিছু বলেন না।

পাহাড়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষকেরা বলছেন, পাহাড় ভ্রমণে গাইডলাইন না মানলে বর্ষায় পাহাড়ে না যাওয়াই ভালো। পর্যটকদের উচিত পাহাড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত থাকা এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। কারণ, ভ্রমণের মতো রোমাঞ্চে ভরা কার্যক্রমগুলো করার সময় অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি হ্যাপি হরমোন নিঃসৃত হয়; এর মাত্রা বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অভিযাত্রীরা অসতর্ক হয়ে পড়েন, ফলে ঘটে দুর্ঘটনা।

কুমিল্লা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক ফজলে ইলাহি জানান, ঘুরতে আসার জন্য গাইডরা শুধু পাহাড়ে ছয়-সাত ঘণ্টা হাঁটতে হবে বলে নিয়ে আসেন। জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী নিয়ে আসতে হবে কি না, তা কেউ বলেন না।

জানা যায়, চলতি মাসে আলীকদমের ক্রিসতং পাহাড়, থানচির লিমান লিবলু এবং সাকাহাফং অভিযানে ৩৩ জনের একটি দল পাঁচ দিনের ভ্রমণে বের হয় ‘ট্যুর এক্সপার্ট’ নামের এক ফেসবুক ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গে। দলটির ২২ জনের দলের ৩ জন ১১ জুন শামুকঝিরি ঝরনায় পাহাড়ি ঢলে ভেসে যান। তাঁদের মধ্যে ১৯ জন ফিরে এলেও জুবাইরুল ইসলাম, হাসান চৌধুরী ও স্মৃতি আক্তার নিখোঁজ হন। পরে ১২ জুন জুবাইরুলের লাশ এবং ১৩ জুন স্মৃতির লাশ পাওয়া যায়, তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ট্যুর গ্রুপের হোস্ট হাসান।

এ ঘটনায় স্মৃতি আক্তারের বাবা যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা, আবহাওয়ার সতর্কতা এবং প্রশাসনিক অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ আয়োজন এবং আয়োজকদের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ট্যুর এক্সপার্ট গ্রুপের মূল অ্যাডমিন বর্ষা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে তিনি জামিনও পান। এর আগে ২০২৩ সালের ১২ আগস্ট এই বর্ষার স্বামী মোহাম্মদ আতাহার ইশরাক রাফি আলীকদমে সাইম্প্রা ঝরনায় গিয়ে খাদ থেকে পড়ে মারা যান।

বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর (নিবন্ধন ও পরিচালন) বিধিমালা, ২০২৪ অনুযায়ী, পর্যটকদের সঙ্গে প্রতারণা, মিথ্যা তথ্য প্রদান, নিরাপত্তা অবহেলা, নিবন্ধনবিহীন সেবা, শিশুশ্রম বা প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি—সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

উপজেলার মেঘচূড়া হিল রিট্রিটের মালিক মোহাম্মদ মাসুম জানান, পর্যটকদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার কারণে আলীকদমে পর্যটকের আনাগোনা কমে আসছে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবার নিয়ম মেনে ভ্রমণে আসা উচিত।

পর্যটকদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, পাহাড় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই এমন মানুষ বিপজ্জনক বর্ষা মৌসুমে ভ্রমণে আসছে। অধিকাংশ পর্যটক জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী, সেফটি জ্যাকেট, রশি, টর্চলাইট, পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করেন না। ফলে পর্যটকদের একের পর এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হচ্ছে।

আলীকদম উপজেলা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিন্টু কর্মকার বলেন, ‘আমরা জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী এখনো ব্যবহার করিনি। তবে এবার থেকে সেফটি জ্যাকেট নিয়ে যাব।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পর্যটকদের জন্য জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী, সেফটি জ্যাকেট, রশি ও টর্চলাইট বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত