Ajker Patrika

ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঝাউবন

  • জিও ব্যাগ দিয়েও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
  • গত কয়েক দিনে তিন শতাধিক ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে।
  • রোপণ করা সাড়ে ৭ লাখ ঝাউগাছের অর্ধেক বিলীন।
  • সৈকতের ভাঙনরোধে ৬৪২ কোটি টাকার প্রকল্প।
মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫, ০৭: ২৭
বর্ষার শুরুতে ভাঙন দেখা দিয়েছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগানে। জিও ব্যাগ ফেলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি সৈকতের কবিতা চত্বরে। 	ছবি: আজকের পত্রিকা
বর্ষার শুরুতে ভাঙন দেখা দিয়েছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগানে। জিও ব্যাগ ফেলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি সৈকতের কবিতা চত্বরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রতিবছর ভাঙনে সংকুচিত হচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। এ বছর বর্ষার শুরুতে ভাঙনের কবলে পড়েছে সৈকতের সবুজ বেষ্টনী হিসেবে পরিচিত ঝাউবাগান। গত ১৫ দিনে কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে সৈকততীরের দৃষ্টিনন্দন ঝাউবন সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জিও ব্যাগ দিয়েও তা ঠেকানো যাচ্ছে না।

গত মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ ডায়াবেটিক পয়েন্ট, কবিতা চত্বর, শৈবাল, লাবণী, সুগন্ধা এবং কলাতলী পয়েন্ট। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বিস্তৃত সৈকতের এসব পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জিও ব্যাগের বাঁধ বানিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক যুগ ধরে পাউবো ভাঙন ঠেকানোর এই কাজ করে এলেও তেমন একটা সফলতা পায়নি। শুধু কক্সবাজার শহরে নয়, টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভের হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক ও টেকনাফ সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

শহরের লাবণী পয়েন্টের জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্র থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত ঝাউবন লাগোয়া উঁচু করে দেওয়া হয়েছে জিও ব্যাগভর্তি বালুর বাঁধ।

নষ্ট হচ্ছে সাগরপারের সৌন্দর্য

সরেজমিনে দেখা গেছে, জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট উচ্চতায় জিও ব্যাগে আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের চাপে ঝাউবন ও তীর রক্ষায় বসানো জিও ব্যাগগুলো ছিঁড়ে তছনছ হয়ে সাগরে মিশে যাচ্ছে। মোটেল শৈবাল থেকে ডায়াবেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত এক কিলোমিটার সৈকতে জিও ব্যাগের বাঁধ ছাপিয়ে জোয়ারের পানি ঝাউবনে ঢুকে পড়ছে। এতে শিকড় উপড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে ঝাউগাছ।

জেলা প্রশাসনের বিচ কর্মীদের সহকারী সুপারভাইজার বেলাল হোসেন বলেন, সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত এ বছর বর্ষার শুরুতেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে বালিয়াড়ি বিলীন হয়ে পড়ায় সাগরপারের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।

সৈকততীর রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে বালিয়াড়িতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে বালিয়াড়ি ক্ষয় হয়ে তীরে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।’

সাড়ে ৭ লাখ ঝাউগাছ রোপণ

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শীলখালী পর্যন্ত ৪৮৫ হেক্টর জায়গায় ঝাউবন সৃজন করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ঝাউগাছ রোপণ করা হলেও অর্ধেক বিলীন হয়ে গেছে। মেরিন ড্রাইভের ইনানী, হোয়াইক্যং, শীলখালী ও টেকনাফ রেঞ্জের আওতাধীন ঝাউবাগানও বিলীনের পথে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর ভাঙনে ঝাউবন সংকুচিত হয়ে আসছে। গত কয়েক দিনের ভাঙনে তিন শতাধিক ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে।

ভাঙনরোধে করণীয়

গত সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার শহর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দেয়। সে সময় সৈকতে এমন ভাঙনের কারণ অনুসন্ধান করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা ভাঙনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি ভাঙনরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা তুলে ধরে বেশ কিছু সুপারিশ দেয়।

এ দলের নেতৃত্ব দেওয়া বোরির পরিবেশ ওশানোগ্রাফি ও জলবায়ু বিভাগের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু শরীফ মো. মাহবুব-ই কিবরিয়া বলেন, কক্সবাজার শহরে সৈকতে বালিয়াড়ির ক্ষয়রোধে প্রাকৃতিকভাবে যে বায়োশিল্ড বা জৈব প্রতিরোধব্যবস্থা ছিল, তা এখন নেই। সাধারণত প্রাকৃতিক সৈকতে তিন ধাপের উদ্ভিদ থাকে। এগুলোর মধ্যে প্রথম ধাপে সাগরলতাজাতীয় বীরুৎ উদ্ভিদ, এরপর নিশিন্দা, কেয়া, আকন্দের মতো গুল্ম উদ্ভিজ্জ এবং তৃতীয় ধাপে হিজল, তমাল অথবা ঝাউজাতীয় বৃক্ষ। বালিয়াড়ি গঠন ও ভাঙনরোধে সাগরলতা বেশি কার্যকর হলেও কক্সবাজারের উপকূলে তা নষ্ট করে প্রথম ধাপেই অপরিকল্পিতভাবে ঝাউগাছ সৃজন করা হয়েছে।

৬৪২ কোটি টাকার প্রকল্প

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল মুর্শিদ বলেন, কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে কলাতলী পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার সৈকতের ভাঙনরোধে ৬৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই এ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে। এই প্রকল্প জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকবে বলে জানান তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত