Ajker Patrika
  • ফর্টিস চেইন হাসপাতালের নাম দেখে এএফসি হেলথকে ঋণ দিয়ে বিপাকে ইবিএল
  • প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা সুদাসলে প্রায় ৯০ কোটি টাকা
  • পুঁজিবাজার থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছে এএফসি হেলথের দুই প্রতিষ্ঠান

ফর্টিস হাসপাতালের নামে শতকোটি টাকা লোপাট

ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম
ফর্টিস হাসপাতালের নামে শতকোটি টাকা লোপাট

ভারতীয় চেইন হসপিটাল ফর্টিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউটের নাম ভাঙিয়ে শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে এএফসি হেলথ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও কুমিল্লায় ‘ফর্টিস’ নামে চারটি শাখা হাসপাতাল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে এবং দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কারখানা দেখিয়ে শেয়ারবাজার থেকে এই টাকা তুলে নেয়।

এর মধ্যে সব সেবা বন্ধ হয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারবাজারে থাকা দুই কোম্পানির লেনদেন চলছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত বিনিয়োগকারীরা। আর ব্যাংক চিন্তিত অনাদায়ি ঋণ নিয়ে।

ফর্টিস চেইন হাসপাতালের নাম দেখে এএফসিকে ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়া ব্যাংকটির নাম ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)। হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গত সাত বছরেও শোধ করেনি এএফসি হেলথ লিমিটেড, যা এখন সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি টাকায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতের একটি নামকরা হসপিটাল ফর্টিস। এএফসি হেলথের মাধ্যমে দেশে হার্টের চিকিৎসাসেবা চালু করে ফর্টিস। তখন এএফসির এই উদ্যোগকে অনেকে স্বাগত জানায়। চট্টগ্রামে ফর্টিসের স্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে ২০১৮ সালে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইবিএল। কিন্তু হাসপাতাল নির্মাণের নামে ঋণ নিলেও অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতায় দীর্ঘদিনে হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারেনি উদ্যোক্তারা। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ আটকে যায়, যা বর্তমানে সুদাসলে প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

পাওনাদার ব্যাংক ও আদালতের তথ্যমতে, ৭২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ঋণখেলাপি হওয়ায় এএফসি হেলথের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর অর্থঋণ মামলা করে ইবিএল আগ্রাবাদ শাখা। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের সঙ্গে এএফসি হেলথের দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক লিমিটেড ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডকেও বিবাদী করা হয়। মামলায় ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির সাত কর্ণধারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন অর্থঋণ আদালতের তৎকালীন বিচারক মুজাহিদুর রহমান।

নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন এএফসি হেলথ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুয়েল খান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম সাইফুর রহমান, পরিচালক মো. আফজাল, মো. জিয়া উদ্দিন, সাইদুল আমিন, মো. শামসুদোহা তাপস এবং মাহবুব আরাব মজুমদার।

ইবিএলের লিগ্যাল কর্মকর্তা বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশের পর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারেরা ঋণটি পুনর্গঠনের আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী শ্রেণীকৃত ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ নেই। তাই ব্যাংক এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। এ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার আদেশটি প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করেছেন কর্ণধারেরা। ওই আবেদনে সিকিউরিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা, কুমিল্লা ও খুলনার ১৯১ শতক জমি সংযুক্ত করার আবেদনও করেছেন। আমরা ওই জমির মূল্য পর্যবেক্ষণ করে আদালতে মতামত জানাব।’

এই ঋণ এর আগে দুবার পুনঃ তফসিল করা হলেও ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। ব্যক্তিগত সিকিউরিটিতে দেওয়া এই ঋণের কোনো বন্ধকি সম্পত্তিও ব্যাংকের কাছে নেই বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা।

ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হলেও এএফসি হেলথের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে ঢাকার নিকেতন এবং তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের সাত কর্ণধারেরও ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে ঢাকার সূত্রাপুর, পুরানা পল্টন, তেজগাঁও, নিকেতন, শ্যামনগর এলাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এএফসি হেলথ লিমিটেড ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম, খুলনা ও কুমিল্লায় টারশিয়ারি লেভেল বিশেষায়িত কার্ডিয়াক কেয়ার চেইন হাসপাতাল পরিচালনা করে। এ ছাড়া যশোরে বেসিক মেডিকেল সেবায় আউটরিচ সেন্টার এবং ময়মনসিংহে মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল চালুর উদ্যোগও নিয়েছিল এএফসি। কিন্তু এরই মধ্যে এএফসির সব প্রকল্প কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের শেভরন হসপিটালের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালে শেভরনের দুটি ফ্লোর (৮ ও ৯ তলা) ভাড়া নিয়ে ফর্টিস হার্ট ইনস্টিটিউট নামে বিশেষায়িত কার্ডিয়াক কেয়ার চালু করে এএফসি হেলথ। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও চিকিৎসক ও রোগীর তেমন সাড়া মেলেনি। হাসপাতালের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি কিনে অর্থ ব্যয় করলেও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ছিল। ফলে ২০২১ সালে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির কাছে ভাড়া বাবদ শেভরনেরও প্রায় ২ কোটি টাকা পাওনা বাকি আছে এএফসি হেলথের কাছে।

এদিকে দেশের তিন বিভাগীয় শহরে ফর্টিস হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও শেয়ারবাজারে রয়েছে এফসি হেলথের দুই প্রতিষ্ঠান।

এর মধ্যে একটি হলো এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক লিমিটেড এবং অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যমতে, এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক লিমিটেডের মোট শেয়ার ১১ কোটি ৫২ লাখ ১৬ হাজার ২০০। এর মধ্যে পরিচালকদের কাছে ২৭ দশমিক ৮৪, আর্থিক সংস্থার কাছে ৩৩ দশমিক ১৮ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার ৯ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়।

অপর কোম্পানি অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডের মোট শেয়ার ২৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে পরিচালকদের হাতে ১২ দশমিক ৪, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে আছে ২০ দশমিক ১৭, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে শূন্য দশমিক ২৭ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৭ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গতকাল ৮ দশমিক ৩০ টাকায় কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। অ্যাকটিভ ফাইন বাজারে আসে ২০১০ সালে।

২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদনের জন্য এএফসি হেলথ লিমিটেড প্রসপেক্টাসে মিথ্যা বিবৃতি ও ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে বলে অভিযোগ আনে ভারতের ফর্টিস এসকর্টস।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) পাঠানো এক চিঠিতে ফর্টিস অভিযোগ করে, প্রসপেক্টাসে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের মাধ্যমে এএফসি হেলথকেয়ার বিনিয়োগকারী ও জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে, এএফসি হেলথকেয়ার খুলনা ও চট্টগ্রামে কার্ডিয়াক ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দিতে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। তবে এএফসি ওই চুক্তি ভঙ্গ করে কুমিল্লা ও যশোর জেলায় তাদের হাসপাতালেও ফর্টিস ও এসকর্টস ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে, যা চুক্তির পরিপন্থী। এ ছাড়া এএফসি হেলথকেয়ারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পরিশোধ না করার অভিযোগ আনা হয় ওই চিঠিতে।

এর এক মাস আগে ১৬ সেপ্টেম্বর এএফসি হেলথকেয়ারকে পুঁজিবাজার থেকে অভিহিত মূল্যে ১৭ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমতি দেয় এসইসি।

এএফসি হেলথ লিমিটেডের পরিচালক সাইদুল আমিন বলেন, ‘হসপিটালের প্রজেক্টগুলোতে বিনিয়োগের পর প্রফিটে আসতে সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে দীর্ঘদিন হাসপাতালের কার্যক্রম স্থবির থাকায় আমাদের লোকসান হয়েছে।’

সাইদুল আমিন আরও বলেন, ‘ইবিএলের ঋণটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি। দুটি কারখানার একটিতে স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন চলছে। কারখানা দুটি পুরোদমে চালু করতে আমরা বিনিয়োগ খুঁজছি।’ ফর্টিস নাম দিয়ে শুরু করা হাসপাতালগুলোর মধ্যে কুমিল্লার হাসপাতালটি এএফসি নামে চলছে বলেও দাবি করেন তিনি।

শেয়ারবাজারে লেনদেন চললেও কারখানার উৎপাদন বন্ধ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের দিকে খুলনার বটিয়াঘাটায় কৃষিজমির ওপর নির্মাণ করা হয় এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক লিমিটেড। এরপর ২০১৬-১৭ সালের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদিত হয়। তবে করোনার পর থেকে কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত গ্রুপটির অপর কারখানা অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালসে করোনার আগে প্রায় ৩১টি প্রোডাক্ট তৈরি হতো। তবে দুই বছর ধরে কারখানার উৎপাদন অনেকটা বন্ধ।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অ্যাকটিভ ফাইনের কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স ম্যানেজার বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে কারখানার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ। তবে কারখানা একেবারে বন্ধ হয়নি। এখনো কিছু কিছু প্রোডাক্ট প্রোডাকশন হচ্ছে এবং মার্কেটে যাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদোন্নতি দিয়ে ৬৫ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা: ডিজি

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

সমালোচনার মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের নিয়োগ বাতিল

মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত