Ajker Patrika

স্কুলে ফেরা হলো না ওদের

শিমুল চৌধুরী, ভোলা
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ০৮
Thumbnail image

উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায় মেঘনা পাড়ের বেড়ির ওপরে গড়ে ওঠা একটি ওয়ার্কশপে শ্রমিকের কাজ করতে দেখা গেছে ১২ / ১৩ বছরের এক শিশুকে। তার নাম মো. আরিফ। বাড়ি দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকায়। আরিফের সঙ্গে কয়েক মিনিট আলোচনায় উঠে আসে তার দুঃখগাথা জীবনের কথা। 

ছোটবেলা থেকে ঢাকা মীরের বাগ এলাকায় বসবাস করছিল তারা। সেখানে একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করতে আরিফ। বাবা আচমত আলী নদীতে মাছ শিকার করতেন। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাস এসে তাঁদের জীবনকে যেন এলোমেলো করে দিল। তিন ভাই আর এক বোনের সংসারে দেখা দেয় অভাব অনটন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। মা একজন মানসিক রোগী। ফলে অভাবের তাড়নায় এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই গত প্রায় ১ বছর আগে গ্রামের বাড়ি ও নানা বাড়ি ভোলায় চলে আসে। সেখানে এসে ভোলা সদরের শিবপুরের শান্তিরহাট মেঘনা নদীর পাড়ে অবস্থিত হাফিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে দুই হাজার টাকা মাসিক বেতনে শ্রমিকের কাজ শুরু করে। 

ওয়ার্কশপের মালিক মো. বাচ্চু জানান, করোনার কারণে দরিদ্র আরিফের সংসারে অভাব দেখা দিলে সে পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকা থেকে ভোলায় নিজ গ্রামের বাড়ি চলে আসে। ওদের ৪ ভাই-বোনের অভাবী সংসারের অসহায়ত্ব দেখে তিনি আরিফকে দুই হাজার টাকা বেতনে ওয়ার্কশপে শ্রমিকের কাজ করতে দেন। তার সঙ্গে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থাও করে দেন। 

ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর এলাকায় গড়ে ওঠা মিনার প্লাস্টিকের কারখানায় ৪-৫ জন শিশুকে সুতার কাজ করতে দেখা গেছে। তাদের সবাই সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-মাদ্রাসা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। 

এদের মধ্যে ১৪ বছরের শিশু মো. জোনায়েদ জানায়, সে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ইলিশা বাজার সংলগ্ন আল এহসান হোসাইনিয়া মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় গত প্রায় দুই সপ্তাহ আগে এ কারখানায় এসে দুই হাজার টাকা মাসিক বেতনে সুতার কাজ করছে সে। সঙ্গে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জোনায়েদ সবার বড়। 

প্লাস্টিকের এ কারখানায় একই কাজ করছে ১৩ বছরের শিশু জিসান। তার বাবা মো. হেলাল উদ্দিন একজন কৃষক। জিসান ওই এলাকার রতনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। আর তাই এ দরিদ্র বড় ভাইয়ের ওপর দায়িত্বও বড়। সেই চিন্তা করে করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অভাবের সংসারে আয় করতে গত প্রায় ১ বছর আগে স্কুল থেকে দূরে সরে গিয়ে দুই হাজার টাকা মাসিক বেতনে এ কারখানায় সুতার কাজ করছে সে।

স্কুল থেকে দূরে সরে ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায় মেঘনা নদীর বেড়ির পাড়ে গড়ে ওঠা একটি ওয়ার্কশপে শ্রমিকের কাজ করছে আরিফস্কুলের পড়াশোনা বন্ধ রেখে একই কাজ করছে রতনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মেহেদী (১৪)। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হতদরিদ্র মেহেদীর জন্মের পর পরই তার বাবা জসিম মারা যান। আর মা লাইজুর অন্যত্র বিয়ে হওয়ায় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেহেদী। তাই মিনার প্লাস্টিকের কারখানায় সুতার কাজ করতে হচ্ছে এ শিশুটির। তিন বেলা খাবারের পর মাস শেষে যে দুই হাজার টাকা বেতন পায় তা দিয়েই কোনোমতে চলে যায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু মেহেদীর সংসার। 

স্কুল ছেড়ে দিয়ে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে মো. ওমর নামের আরেক স্কুলছাত্র। সে রতনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। গত প্রায় ২ মাস আগে স্কুল ছেড়ে এ কাজে যোগ দেয়। ওমরের বাবা বাবুল একজন দরিদ্র দিন মজুর। 

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এ কাজে নেমেছে এসব শিশুরা। স্কুল ছেড়ে এখন এটাই তাদের একমাত্র কাজ। একদিকে ব্যাপক সমারোহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল থেকে ছিটকে পড়া এমন বহু শিশু-কিশোরের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। যেই হাতে বই-খাতা আর কলম থাকার কথা, করোনাভাইরাস সে হাতে তুলে দিয়েছে লোহালক্কড়ের কঠিন কাজ। স্কুলগামী এসব কোমলমতি শিশুদের পরিণত করেছে ইস্পাতের কাঠামোয়। স্কুল থেকে ঝরে পড়া উপকূলের অধিকাংশ অসহায় শিশুর গল্পগুলো প্রায় একই রকম। 

এ ব্যাপারে রতনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলছেন, কোনো শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে কি’না সেটা এক সপ্তাহ পর বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে এ বিষয়ে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। 

এ বিষয়ে ভোলা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখর রঞ্জন ভক্ত মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, কি পরিমাণ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে সেটা এক বছর পর জানা যাবে। তবে গত দুই দিনে ৭৩ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যে সব শিক্ষার্থী অভাবের কারণে বিভিন্ন জায়গায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সেকেন্ড চান্স নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। যেখানে ১৪ ক্লাস পর্যন্ত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে তাদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে। 

এ বিষয়ে ভোলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নাজিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এম ফারুকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না। দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকার অনেক শিক্ষার্থী গরিব ও অসহায়। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে দূরে সরে গেছে। অনেকে কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে হলে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর কর্মসূচি নিতে হবে। সেই সঙ্গে এনজিওগুলোও শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বিভিন্নভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে। 

এ দিকে ভোলায় কর্মরত ড্রপ ইনটিগ্রিটি ইন স্কুল ওয়াশ প্রকল্পের স্কুল মোবিলাইজার শান্তা মুনিয়া আজকের পত্রিকাকে জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়। তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও যৌথ গবেষণার বরাত দিয়ে এসব কথা বলেন। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত