Ajker Patrika

নতুন দল ঘোষণায় কেন ৩৭১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্পার্টানদের পরাজয়ের প্রসঙ্গ আনলেন মাস্ক

অনলাইন ডেস্ক
আমেরিকা পার্টি নামে নতুন মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত
আমেরিকা পার্টি নামে নতুন মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করার পর এবার এককভাবে রাজনীতিতে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। এক্স প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে আজ রোববার ভোরে ‘আমেরিকা পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ঘোষণা দেন মাস্ক। ট্রাম্পের সঙ্গে বিচ্ছেদের কয়েক সপ্তাহ পরেই এই ঘোষণা এলো।

প্রেসিডেন্টের ট্রাম্পের সঙ্গে ইলন মাস্কের মতবিরোধের মূল কারণ তাঁর একটি বিশাল ব্যয় এবং কর ছাড়ের বিল, যেটিকে ট্রাম্প ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইলন মাস্ক এই বিলকে ‘স্রেফ উন্মাদনা এবং ধ্বংসাত্মক’ বলে অভিহিত করেছেন।

অবশ্য একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ধারণা মাস্কের মনে সব সময়ই ছিল। কয়েক দিন ধরেই এ নিয়ে তিনি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে যাচ্ছেন। বিলটিতে ট্রাম্পের স্বাক্ষর করার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। হোয়াইট হাউসে গত ৪ জুলাই ট্রাম্প বিলটিতে স্বাক্ষর করার পরপরই মাস্ক তাঁর সমর্থকদের অনলাইনে জিজ্ঞাসা করেন, নতুন দল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত কিনা।

অনলাইন ভোটে নিজের পক্ষে রায় আসার পর মাস্ক ঘোষণা করেন, ‘২ থেকে ১ এর অনুপাতে আপনারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল চেয়েছেন এবং আপনারা তা পাবেন।’

কেন নতুন দল?

একসময় রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত মাস্ক, দেশের ‘একদলীয় ব্যবস্থা’কে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান। তিনি এক্সে একটি পোস্টে বলেন, ‘আমাদের দেশকে অপচয় ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেউলিয়া করার ক্ষেত্রে আমরা একটি একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি, গণতন্ত্রে নয়। আজ, “আমেরিকা পার্টি” আপনাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে গঠিত হয়েছে।’ ‘ইউনিপার্টি’ শব্দটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি সাধারণ অবস্থা বোঝায়, যখন নীতির ক্ষেত্রে কার্যত সবগুলো দল মিলে একটি দলের মতো আচরণ করে।

‘আমেরিকা পার্টি’ এই ‘ইউনিপার্টি’ ব্যবস্থার মোকাবিলা করবে, এমনটাই পরিকল্পনা ইলন মাস্কের। এই বিলিয়নিয়ার প্রযুক্তিবিদ ৩৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিউক্ট্রার যুদ্ধে স্পার্টান যোদ্ধাদের পরাজয়ের উদাহরণ দিয়ে তিনি সেটি ব্যাখ্যা করেছেন।

মাস্ক বলেন, ‘আমরা যেভাবে ইউনিপার্টি ব্যবস্থাকে ভাঙতে যাচ্ছি, তা হলো অ্যামিনোন্ডাস কীভাবে লিউক্ট্রার যুদ্ধে ‘স্পার্টানরা অজেয়, দুর্দমনীয়’ এই মিথ ভেঙে দিয়েছিলেন তার একটি ভিন্ন রূপ ব্যবহার করে: যুদ্ধক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত শক্তি প্রয়োগ করে।’

কী ঘটেছিল লিউক্ট্রার যুদ্ধে?

লিউক্ট্রার যুদ্ধ ছিল প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সংঘাত। ৩৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ৬ জুলাই থিবস এবং তার মিত্রশক্তি বওইওটিয়ান লিগের সঙ্গে স্পার্টাকাস ও তার মিত্রদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ বওইওটিয়ার থেস্পিয়াপলিসের কাছে অবস্থিত লিউক্ট্রা গ্রামে সংঘটিত হয়।

দীর্ঘকাল ধরে স্পার্টা গ্রিক উপদ্বীপে নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল, বিশেষ করে পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে তাদের বিজয়ের পর। থিবস স্পার্টার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বওইওটিয়ান লিগের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর স্পার্টার রাজা ক্লিওমব্রোটাস প্রথম থিবস আক্রমণ করতে অগ্রসর হন।

থিবিয়ান সেনাপতি এ্যাপামিনোন্ডাস এই যুদ্ধে এক বিপ্লবী সামরিক কৌশল অবলম্বন করেন, যা তৎকালীন প্রচলিত সামরিক নীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে, গ্রিক ফ্যালানক্স (সারি করে দাঁড়ানো পদাতিক বাহিনী) সমান গভীরতার হতো (ডান থেকে বাঁ পর্যন্ত সমান সংখ্যক সৈন্য) এবং পুরো ফ্রন্ট একই সঙ্গে অগ্রসর হতো। কিন্তু এ্যাপামিনোন্ডাস তার সৈন্যদের বাম শাখায় ৫০ জন সৈন্যের গভীরতার এক অভূতপূর্ব ফ্যালানক্স তৈরি করেন, যেখানে স্পার্টানদের ফ্যালানক্স ছিল মাত্র ১২ জনের গভীরতার। এই কৌশলকে ‘অব্লিক অর্ডার’ বলা হয়।

দুর্বল কেন্দ্রীয় এবং ডান শাখাগুলোকে স্পার্টান ফ্যালানক্স থেকে দূরে রাখেন থিবিয়ান সেনাপতি এবং দ্রুত গতিতে বাম শাখাকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্পার্টানরা তাদের সেরা সৈন্যদের ডান শাখায় রাখত, কিন্তু এ্যাপামিনোন্ডাসের এই কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী আক্রমণ স্পার্টানদের ডান শাখাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দেয়।

লিউক্ট্রার যুদ্ধে বিজয়ের পর থিবস গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এ্যাপামিনোন্ডাসের উদ্ভাবনী সামরিক কৌশল পরবর্তীকালের সামরিক নেতাদের, যেমন ম্যাসিডনের ফিলিপ এবং তার পুত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, প্রভাবিত করেছিল। লিউক্ট্রার যুদ্ধ প্রাচীন গ্রিক সামরিক ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং প্রমাণ করে, প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে শক্তিশালী শত্রুকেও পরাজিত করা সম্ভব।

কেমন হবে মাস্কের দল

নতুন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে খুব বেশি বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও, মাস্ক একজন এক্স ব্যবহারকারীর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দলটি মধ্যপন্থী হবে, ঋণের বোঝা কমানোর লক্ষ্য রাখবে, সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করবে এবং প্রযুক্তি-বান্ধব হবে যা আমেরিকাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) এগিয়ে নিয়ে যাবে।

গত বছরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশাল জয়ের পেছনে ইলন মাস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সরকারের গঠনের পর গঠিত তথাকথিত ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি (ডিওজিই) ’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এই দপ্তরের লক্ষ্য ছিল সরকারের ব্যয় এবং ফেডারেল দপ্তরগুলোর কর্মী কমানো। এই উদ্যোগের প্রধান কারিগরও ছিলেন ইলন মাস্ক।

সরকারের ব্যয় কমানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দুজনের মধ্যে ঐকমত্য ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ব্যয় বিলের তীব্র বিরোধিতা করেন মাস্ক। তাঁর মতে, একদিকে সরকারি ব্যয় কমানোর প্রচেষ্টার চলছে, অন্যদিকে ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে। এই পদক্ষেপ জাতীয় ঋণের বোঝা বাড়াবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ট্রাম্পের এই ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ কেন্দ্র করেই ট্রাম্প-মাস্ক বিচ্ছেদ হয়েছে। মাস্কের মতে এই বিল ‘লাখ লাখ কর্মসংস্থান ধ্বংস করবে’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাপক কৌশলগত ক্ষতি’ করবে।

ইলন মাস্ক গত মে মাসের শেষ দিকে মার্কিন প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করেন। এক মাসেরও বেশি সময় পর, তিনি ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান ‘ইউনিপার্টি’র একটি নতুন বিকল্প গঠনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সিনেটররা ট্রাম্পের ‘বিগ, বিউটিফুল বিল’-এর পক্ষে ভোট দিলে তিনি দল ঘোষণা করবেন।

গত ১ জুলাই মাস্ক বলেছিলেন, ‘যদি এই বেপরোয়া ব্যয় বিল পাস হয়, তাহলে পরের দিনই “আমেরিকা পার্টি” গঠিত হবে। আমাদের দেশে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান ইউনিপার্টির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প প্রয়োজন, যাতে জনগণের একটি প্রকৃত কণ্ঠস্বর থাকে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত