Ajker Patrika

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কি মাও সে-তুংয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০০: ৪৫
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়ন চলছে, তা অনেকেই তুলনা করছেন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সঙ্গে। মাও সে-তুং যেমন নিজেকে বিপ্লবী নেতার আসনে বসিয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ভেঙে দিয়েছিলেন, ট্রাম্পও কি ঠিক তেমনভাবেই আমেরিকার ভেতরে এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছেন? এই প্রশ্ন এখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এই তুলনা কি শুধুই চমকপ্রদ, না এর পেছনে রয়েছে বাস্তব কোনো ঐতিহাসিক মিল?

মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসি এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

এপ্রিল মাসে অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান লিখেন, ‘আপনি যদি আমেরিকার বর্তমান পরিস্থিতির একটি মডেল খুঁজতে চান, তাহলে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিকে তাকান।’ শুধু পল একা নন। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে দ্য গার্ডিয়ান ও বিভিন্ন সাবস্ট্যাক ব্লগে—অনেক ভাষ্যকার ট্রাম্পকে মহান নেতা মাও সে-তুংয়ের মার্কিন সংস্করণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

এই ভাষ্যকারদের মতে, মাও সে-তুংয়ের মতোই ট্রাম্পও একটি ঘাঁটি গড়ে তুলেছেন, যারা আমলাতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক অভিজাতদের ধ্বংস করতে এক পায়ে খাড়া। তিনি এমন এক ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন, যেখানে নেতার ইচ্ছাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি তাঁর মতাদর্শগত বিরোধীদের প্রতি নির্মমভাবে অসহিষ্ণু।

তবে এই তুলনা কতটা কার্যকর? মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্টের সদস্যরা কি আসলেই রেড গার্ডদের নতুন রূপ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে একটুখানি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা দরকার।

১৯৬৬-৭৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনের প্রায় প্রতিটি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে ভয়াবহ মানসিক ও সামাজিক ধাক্কা দেয়। মাও সে-তুং ‘বিপ্লববিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করতে লাখ লাখ চীনা জনগণকে উসকে দেন। এতে এক ব্যক্তির শাসন আইনের শাসন বা দলের শাসনকে ছাপিয়ে যায়।

মাও সে-তুংয়ের প্রচারণার প্রথম দিকের চরম পর্যায়ে (১৯৬৬-১৯৬৯ সাল) ছাত্র ও শ্রমিকেরা সহিংস উপায়ে ক্ষমতা দখল করেন। এতে চীনা সমাজের প্রায় সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে। রেড গার্ডরা (যারা প্রধানত মাও পূজারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী) বুদ্ধিজীবীদের ও পশ্চিমা (বিশেষত ইউরোপীয় ও আমেরিকান) সংস্কৃতিভাবাপন্ন যে কাউকে সন্ত্রস্ত করত, বন্দী করত, এমনকি হত্যা করত। ধীরে ধীরে দেশটি গৃহযুদ্ধের কিনারায় পৌঁছে যায়। ব্যাপক গণহত্যা, এমনকি ‘শ্রেণিশত্রুদের’ প্রতিশোধ হিসেবে নরভোজের ঘটনাও ঘটে। ধারণা করা হয়, এই অভিযানে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যে কিছু উপরিতল সাদৃশ্য দেখা যায়: নেতা পূজার আন্দোলন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর (আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়) ওপর হামলা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলোকে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ হিসেবে চিত্রায়ণ। মাও ও ট্রাম্প দুজনই নিজেদের বহিরাগত বা অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিদ্রোহী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং বিশৃঙ্খলার প্রতি তাঁদের আগ্রহ আছে।

তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকের চীন ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি লেনিনবাদী একনায়কতন্ত্র, যা গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছে। এই সমাজটি আধুনিক আমেরিকার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব পুরো চীনা সমাজকে (উচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে স্থানীয় গ্রাম পর্যন্ত) নৃশংসতার জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়, যা থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র রেহাই পেয়েছে।

গত বছর প্রেসিডেন্টাল ইমিউনিটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে একটি কার্যকর (যদিও টানাপোড়েনপূর্ণ) আইনব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান, যা বহুবার ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করেছে। এটি মাও সে-তুংয়ের মতো ‘আবেগ দিয়ে শাসন’ বা ‘এক নেতার স্বেচ্ছাচারিতামূলক’ শাসনের সঙ্গে কিছুতেই তুলনাযোগ্য নয়।

পররাষ্ট্রনীতিতেও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা। মাও ছিলেন মতাদর্শগতভাবে সম্প্রসারণবাদী। যিনি গোটা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে চীনের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক দায়দায়িত্ব কমানো। মাও আশা করেছিলেন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলোতে নতুন প্রাণ আনবে। এমনকি পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার ক্যাফে, বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানায় সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেবে।

অন্যদিকে ট্রাম্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ ভেঙে ফেলতে তাড়াহুড়ো করে পা বাড়িয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন সেই ‘নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা’ পরিত্যাগ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আগের নেতারা তৈরি ও রক্ষা করেছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি মাওবাদী বিশ্বদর্শনের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত।

তাহলে, এত ভাষ্যকার এই তুলনার আশ্রয় নিচ্ছেন কেন? মৌলিকভাবে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দৃষ্টান্তটি উদারনৈতিক বা লিবারেল সমালোচকদের আগের একটি অনুরূপ ব্যাখ্যার পরিপূরক, যেখানে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদকে ট্রাম্পবাদের উত্থানের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এই তুলনার প্রবক্তারা একদিকে যেমন সমাজকে সতর্ক করতে চান, অন্যদিকে কিছুটা স্বস্তিও দিতে চান। তারা বলছেন—হ্যাঁ, এটি একটি সংকটময় মুহূর্ত, কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেয়ে আমেরিকাবিরোধী কিছু আর হতে পারে না। ট্রাম্পকে ‘চেয়ারম্যান মাও সে-তুংয়ের প্রেরিত দূত’ হিসেবে দেখালে, তাকে আমেরিকান জীবনধারার জন্য একেবারে অচেনা ও অচিন হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

কয়েকজন চীন বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক অবশ্য বলছেন, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই তুলনা চীনা জনগণের মুখ থেকেই উঠে এসেছে। ফলে এটিকে আরও সত্য ও অর্থবহ মনে হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশ্চিমা ভাষ্যকাররাই ‘আমেরিকায় মাওবাদের আবির্ভাব’ নিয়ে বেশি সরব হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায়, হয়তো অজান্তেই তাঁরা ‘আমেরিকার সমস্যা মানেই চীনের প্রভাব’— এই পুরোনো ধারণার নতুন অধ্যায় লিখে ফেলেছেন।

১৮৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল চীনা জনগণ। শীতল যুদ্ধের (কোল্ড ওয়ার) সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের মধ্যে চীনা প্রভাব নিয়ে সন্দেহ ছিল প্রবল। ২০১০ এবং ২০২০-এর দশকে সেই ভীতি আবার ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শৃঙ্খলাকে চীন ছাড়িয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কা বহুদিন ধরে উদারনৈতিক নীতিনির্ধারক ও ভাষ্যকারদের মধ্যে বিদ্যমান।

বারাক ওবামার ‘পিভট টু এশিয়া’ নীতি চীনের প্রভাব ঠেকাতে চেয়েছিল, যা পরে জো বাইডেন আরও জোরালোভাবে চালু করেন। তিনিও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদের চাপানো ট্যারিফ এবং চীনবিরোধী ভাষার বহর বজায় রেখেছেন। ফলে এই ভয় যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল চীনের পেছনে পড়বে না, বরং তাদের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের (সাংস্কৃতিক বিপ্লব) মুখে পড়তে পারে। বিষয়টি একাধারে ভয়ংকর ও অপ্রতিরোধ্য।

তবু বাস্তব সত্য হলো, ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির সবচেয়ে যৌক্তিক ঐতিহাসিক উপমা ও শিকড়গুলো বিদেশে নয়, দেশীয় ইতিহাসেই নিহিত। ১৭৯৮ সালের ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ থেকে ১৯৫২ সালের ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট’ পর্যন্ত— যেসব আইনকে ট্রাম্প অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, তার জন্য নতুন কোনো আইন পাস করার প্রয়োজন হয়নি। নির্বাহী আদেশের ব্যাপক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আগের অনেক প্রেসিডেন্টই স্থাপন করেছেন। এর মূল কারণ হলো, মার্কিন আইনসভা ক্রমেই অকার্যকর হয়ে পড়ছে, যা কোনো প্রেসিডেন্টই এখনো সংস্কার করতে পারেননি।

জাতিবাদ (নেটিভিজম) যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ট্রাম্পের বিখ্যাত স্লোগান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের যুগের নাৎসিবাদী বক্তব্যকেই মনে করিয়ে দেয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা আমাদের চমকে দিতে পারে এবং ট্রাম্পবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু যদি আমরা ‘মাগা-মুহূর্ত’ বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন-এর স্থানীয় শিকড়গুলো উপেক্ষা করে কেবল বিদেশি উপমা খুঁজি, তাহলে এই সংকটের প্রকৃত বিপদ ও সম্ভাব্য সমাধান— দুটোই আমাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত