Ajker Patrika

জীবাণু যখন রাজনীতির পথনির্দেশক

গোলাম ওয়াদুদ
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০: ০২
জীবাণু যখন রাজনীতির পথনির্দেশক

মহামারির মতো স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা বরাবরই যেকোনো দেশের প্রশাসনের জন্য এক বিরাট সংকটের সৃষ্টি করে। আজকের এই করোনাভাইরাসই যেমন বহু দেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে। ওলটপালট করে দিচ্ছে অনেক কিছু। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে বিষয়টি কিছুটা বোঝা যাবে। দেশটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনই হয়তো এখনো বাস্তব থাকত, যদি না সেখানে করোনা মহামারি এত বাজে রূপ না নিত। ঠিক একইভাবে পাশের দেশ ভারতে করোনা মহামারি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে সেখানকার নরেন্দ্র মোদি সরকারও বিপাকে পড়ে। 

এটি শুধু এই সময়েই নয়। আগেও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে মহামারির মতো পরিস্থিতি একটি দেশের বা সমাজের গতিপথকে পাল্টে দিতে। ২০১৭ সালে যেমন জাম্বিয়াতে হয়েছিল। সেখানে কলেরার প্রকোপ এতটাই বেড়েছিল যে, তা দেশটির শাসক দলের স্বস্তি তো বটেই, ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। একই সঙ্গে ওই সময় জাম্বিয়াতে তৈরি হওয়া প্রগতিশীল ধারা পথ হারিয়ে বসেছিল। এক ধরনের কট্টর মতবাদ তখন দেশটির ওপর চেপে বসে। করোনার এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ঠিক উল্টো ফল না হলেও কাছাকাছি একটি জায়গায় নিয়ে গেছে দেশটিকে। 

চলতি বছরের শুরুর দিকে, বিশেষত কুম্ভমেলা ও এর পর বিভিন্ন রাজ্যের চলা বিধানসভা নির্বাচনের পর ভারতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সেই পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দিতে পারলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সেই ভয়াবহ দুঃসময়ে দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। মৃতের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, মরদেহ সৎকারের জন্য লম্বা লাইন দিতে হয়েছিল। 

অবধারিতভাবেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারের ওপর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই সময়ে ভারতীয়রা টুইটারে এমনকি হ্যাশট্যাগ রিজাইনমোদি লিখে প্রচারও শুরু করে। ফলে নড়েচড়ে বসতে হয় মোদি সরকারকে। স্বীকার করতে হয় যে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। বাড়াতে হয় তৎপরতা। সেই তৎপরতার সুফল এখন কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। তবে সে সময় যে মোদিবিরোধী আওয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছিল, তা স্তিমিত হয়নি। বিরোধী পক্ষ সেই জনরোষকে কাজে লাগাতে প্রচার শুরু করে। আজকের এই পেগাসাস কাণ্ড নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে যে তোলপাড় হচ্ছে, তার শুরুটা কিন্তু করে দিয়েছিল করোনাভাইরাসই। 

ভারতের রাজনীতির মাঠে একটা অণুজীব যা করে দেখিয়েছে, তা এমনকি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতারাও করতে পারেননি। অবশ্য ভারতের রাজনীতিতে কোনো অণুজীবের এমন দাপট এটাই প্রথম নয়। এর আগেও এমনটা হয়েছিল। তবে তা বহু আগে। 

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে মোদি সরকার কুম্ভ মেলা আয়োজনে ছাড়পত্র যে ছাড়পত্র দিয়েছিল, তা বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়বম্বে প্লেগ ও রাজনীতি
ঐতিহাসিকভাবে মহামারি বা দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় একটি দেশের জনমানসে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। কারণ, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সমাজের ভেতরে থাকা বৈষম্য ও অন্যায্যতার চিত্রটি প্রকট হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষটি হয়েছিল একটি দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ১৮৭৭-৭৮ সালে ডেকান দুর্ভিক্ষের কথাই বলা হচ্ছে। সে সময় কৃত্রিম এই দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল, যা ‘ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। 

এই দুর্ভিক্ষের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রণয়নের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হতে থাকে যে,১৮৮৫ সালে জন্ম হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের। একজন ইংরেজের হাতেই জন্ম নেয় কংগ্রেস দল। তখনো কংগ্রেসকে সে অর্থে রাজনৈতিক দল বলা যাবে না। তরুণ–যুবাদের ভেতরে জন্ম নেওয়া ক্ষোভের আগুন থেকে ব্রিটিশ রাজকে রক্ষা করার পরোক্ষ লক্ষ্যই বরং এর মূলে ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতার বিকাশের কারণে দলটি আর এই লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেনি। মূলত মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বজাতি ও স্বদেশের ডাকে তাকে সাড়া দিতে হয়েছিল। আর এই রাজনৈতিক সচেতনতাটি তৈরি হয়েছিল মাত্র এক দশকের ব্যবধানে, যখন প্লেগ হানা দিয়েছিল ভারতে। 

 ১৮৯৫-৯৬ সালের বম্বে প্লেগের কেন্দ্রস্থল ছিল পশ্চিম ভারত। এতে অন্তত ২০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। এই মহামারি ভারতের রাজনীতির ইতিহাসই বদলে দেয়। ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের নবপর্যায়ের সূচনাটি হয়েছিল এই বম্বে প্লেগের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণেই। সে সময় মানুষ দেখেছিল তারা কতটা অনিরাপদ। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য ও ইংরেজদের থেকে ভারতীয়দের যে পৃথক্‌করণ, তার রূপটি তখন আরও প্রকাশ্য হয় ওঠে। ফলে শুধু সভা–সমিতি কেন্দ্রিক রাজনীতির যে রূপ, তা থেকে বেরিয়ে এসে সক্রিয় একটা পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়েছিল ভারতীয় রাজনীতিকে। 

প্লেগের মতো মহামারির মধ্যেও একই রোগে আক্রান্ত রোগীদের একেকজনের সঙ্গে একেক ধরনের আচরণ মানুষকে বৈষম্যের ধারণাটি বুঝতে সহায়তা করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই দুর্যোগের সময় আগা খান ও বাল গঙ্গাধর তীলকের মতো নেতারা এগিয়ে এসেছিলেন। আরও ভালো করে বললে, তাঁরা এই সময়েই নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

বাল গঙ্গাধর তীলকের ‘কেশরী’ সংবাদপত্রের ১৮৯৭ সালের একটি বর্ণনায় জানা যায়, শূদ্রের ছোঁয়ার আশঙ্কায় এক ব্রাহ্মণ শুধু দুধ খেয়ে থাকতেন। ভিন্ন জাতের হাতে মরদেহ ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থাতেও জমছিল ক্ষোভ। প্লেগের টিকা নিয়ে গুজব ছিল যে, এই টিকা নিলে বন্ধ্যাত্ব অবশ্যম্ভাবী। সংশয় কাটাতে এগিয়ে আসেন আগা খান, বাল গঙ্গাধর তিলকের মতো লোকেরা। বাল গঙ্গাধর প্লেগের বছরে জননেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

মোদ্দা কথা বম্বে প্লেগের সময়ই মূলত ভারতীয়রা ব্যাপকভাবে রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে। এই সচেতনতা পরে কীভাবে, স্বরাজ, স্বদেশি, অসহযোগ ইত্যাদি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, তা অন্য আলোচনার বিষয়। 

করোনাভাইরাস ও মোদি সরকার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বর্তমান বিশ্বের লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর বাক্চাতুর্যের কাছে হার মানতে হয় সবাইকে। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের ধকলে তিনি কিছুটা ব্যাকফুটে গিয়েছেন বলতে হয়। সঙ্গে হালে যোগ দিয়েছে পেগাসাস কেলেঙ্কারি। 

 ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মোদি আবেগঘন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এবং অতি অবশ্যই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কার্ড খেলে নিজের মসনদকে পাকা করেছেন। এনেছেন নাগরিকত্ব আইনসহ নানা বিষয়। বিরোধী মাত্রই ‘আরবান নকশাল’ বলে একটি ট্যাগেরও বেশ প্রচার করেছে তাঁর দল বিজেপি। বিজেপির কট্টর জাতীয়তাবাদী এই রাজনীতি দেশ–বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হলেও দলটির নেতারা পিছু হটেননি। কিন্তু করোনাভাইরাস এই সবই বদলে দিয়েছে। প্রথম ধাক্কাটি এসে লাগে প্রথম লকডাউন ঘোষণার সময়ই। কিছুমাত্র সময় না দিয়েই লকডাউন ঘোষণার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষেরা পড়েন ভীষণ বিপাকে। মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার জনস্রোত বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। ব্যাপক সমালোচনা হয়। সেই সময়ই প্রমাদ গুনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর তা আবার সামলে উঠলেও এবারের ধাক্কায় বেশ বেকায়দায় পড়েছেন বলতে হবে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরাবরই তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় আনুগত্য দাবি করে আসছেন। না, সরাসরি এমন কোনো কথা তিনি বলছেন না বা বলেননি। কিন্তু তাঁর বক্তব্যগুলোর মূল সুরই থাকে এমন। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও তিনি এমন বক্তব্যই দিয়ে আসছিলেন। ফলে যখন কুম্ভ মেলার জন্য পথ খুলে দিলেন বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিত দিলেন, তখন তা নিয়ে সমালোচনা হলো। কিন্তু ‘লৌহমানব’ ধরনের ভাবমূর্তি নিয়ে চলা নরেন্দ্র মোদি তাতে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বরং বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতের এ মাথা–ও মাথা চষে বেড়ালেন। নির্বাচনে সব লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও করোনা ঠিকই তার লক্ষ্যে পৌঁছে গেল। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেশটিকে অন্য রকম এক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এল। আর এই আলোচনার পথ ধরেই নতুন করে বিপাকে পড়লেন মোদি। এখন তো করোনাভাইরাসের সঙ্গে যোগ হয়েছে পেগাসাস কেলেঙ্কারি। আর মোদিবিরোধী জোট এখন আর কথায় নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কুয়েটে ক্লাস বর্জন নিয়ে শিক্ষক সমিতিতে মতবিরোধ, এক শিক্ষকের পদত্যাগ

২ ম্যাচ খেলেই মোস্তাফিজ কীভাবে ৬ কোটি রুপি পাবেন

দুটি নোবেলের গৌরব বোধ করতে পারে চবি: প্রধান উপদেষ্টা

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রশ্নে যে প্রতিক্রিয়া জানাল যুক্তরাষ্ট্র

বিড়াল নির্যাতনের ঘটনায় গ্রামীণফোন ও অ্যারিস্টোফার্মা কেন আলোচনায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত