অনলাইন ডেস্ক
গত এপ্রিল মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে, যে ঘোষণা অস্থির করে তোলে বিশ্ব অর্থনীতিকে। তারপর বেশির ভাগ শুল্ক বাস্তবায়ন স্থগিত করতে বাধ্য হন ট্রাম্প। চার মাস পর আবারও বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প। আর এই শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য চুক্তিকে নিজের সাফল্য হিসেবে অভিহিত করছেন তিনি।
ট্রাম্প কিছু বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন আর অন্যদের ওপর একতরফাভাবে শুল্ক চাপিয়েছেন। তবে এবার দেশগুলো কিছুটা প্রস্তুতই ছিল বলা যায়। এ কারণে গত এপ্রিলের মতো অস্থির অর্থনীতির দেখা মিলছে না।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করতে চান ট্রাম্প। অন্তত এই দাবিতেই শুল্ক আরোপ বাড়িয়েছেন তিনি। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নতুন রাজস্বের, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শিল্প পুনরুজ্জীবিত করার এবং দেশে শত শত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসার ও মার্কিন পণ্য কেনার চুক্তির।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন হবে বা এর নেতিবাচক ফলাফল কতটা পড়বে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এখন পর্যন্ত যা পরিষ্কার তা হলো, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগেই যেখানে বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ ধীরে ধীরে কমছিল, সেখানে ট্রাম্পের পদক্ষেপ সেটিকে রীতিমতো এক ঢেউয়ে পরিণত করেছে, যা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে। যদিও এখনো সেই পরিবর্তনের পূর্ণ প্রভাব বোঝা যায়নি। কারণ এমন পরিবর্তনে ফলাফল সামনে আসে দেরিতে।
অনেক দেশের জন্যই এই শুল্ক আরোপ একধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে এসেছে। বাণিজ্যিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তায় নতুন জোট গঠন নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ফলে, স্বল্প মেয়াদে ট্রাম্প যা ‘জয়’ হিসেবে দেখছেন, সেটি তাঁর বৃহত্তর কৌশলিক লক্ষ্যপূরণে কতটা কাজে দেবে, তা অনিশ্চিত। আর এর প্রভাব ট্রাম্পের জন্য এবং দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকার ওপর পড়তে যাচ্ছে, তা একেবারেই ভিন্ন হতে পারে।
‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’, যে সময়সীমা নিয়ে এসেছিল আতঙ্ক
আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের ক্যালেন্ডারে ১ আগস্ট তারিখটি লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত ছিল। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করো, নইলে ধ্বংসাত্মক শুল্কের মুখোমুখি হও।
হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো যখন ‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’র ঘোষণা দেন এবং ট্রাম্প নিজেও দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের আশাবাদী মন্তব্য করেন, তখন থেকেই বিশেষজ্ঞদের কাছে সময়সীমাটি অবাস্তব বলেই মনে হচ্ছিল এবং বাস্তবেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
জুলাই মাসের শেষে এসে দেখা গেছে, ট্রাম্প মাত্র এক ডজন বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা করেছেন, যার অনেকগুলোই এক-দুই পৃষ্ঠার বেশি নয়। এসব চুক্তিতে সাধারণত যেসব বিশদ ও বাধ্যবাধকতামূলক শর্ত থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
এই পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য অংশীদারদের অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। প্রশ্ন থেকে গেছে চুক্তিগুলোর ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিয়ে।
প্রথম ধাক্কা লেগেছিল যুক্তরাজ্যে
ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সেই ঘাটতি তুলনামূলকভাবে প্রায় ভারসাম্যপূর্ণ। ফলে যুক্তরাজ্যের বেলায় দ্রুত অগ্রগতি হওয়াটা খুব একটা বিস্ময়ের নয়।
বেশির ভাগ ব্রিটিশ পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ প্রাথমিক শুল্কহার আরোপ প্রথমে কিছুটা কপাল কুঁচকানোর মতো ছিল ঠিকই, তবে সেটিই পরবর্তী পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটিও কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের মতো অংশীদারদের ওপর যেখানে শুল্ক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি যথাক্রমে ২৪০ বিলিয়ন ডলার ও ৭০ বিলিয়ন ডলার (শুধু গত বছরে) সেখানে যুক্তরাজ্যের হার ছিল তুলনামূলক সহনীয়।
তবে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের এসব চুক্তি শর্তহীন ছিল না। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কেনার বিষয়ে স্পষ্ট অঙ্গীকার দিতে পারেনি, তারা অনেক সময় উচ্চ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক দেশকে শুল্ক চিঠি পাঠাতে থাকে। বর্তমানে বেশির ভাগ আমদানি যুক্তরাষ্ট্রে এখন কোনো না কোনো চুক্তি বা প্রেসিডেন্টের একতরফা আদেশের আওতায় পড়ে আর এসব আদেশের শেষে থাকে ট্রাম্পের সংক্ষিপ্ত বার্তা: ‘এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘ক্ষতি’ করার ক্ষমতা
গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ অনেক কিছু উন্মোচন করেছে। তবে ভালো খবর হলো শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ শুল্ক এবং মন্দার আশঙ্কা এড়ানো গেছে। উচ্চ শুল্কহার এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন শুল্ক শর্তে সম্মত হওয়ায় একটা বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। যে অনিশ্চয়তা ট্রাম্প নিজেই গত মাসগুলোতে একধরনের অর্থনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় একদিকে যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় পরিকল্পনা করতে পারছে, তেমনি বিনিয়োগ ও নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও আবার সচল হচ্ছে।
বেশিরভাগ রপ্তানিকারক এখন জানেন, তাদের পণ্যের ওপর কত শতাংশ শুল্ক বসছে এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা খরচ কীভাবে সামলাবেন বা ভোক্তার ওপর কতটা চাপ দেবেন, সেটাও হিসাব করতে পারছেন।
এই ক্রমবর্ধমান স্পষ্টতা বিশ্ব অর্থবাজারে তুলনামূলক স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য একটি দিক থেকে এটি নেতিবাচকও বটে। কারণ এখন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির গড় শুল্কহার আগের তুলনায় বেশি এবং ছয় মাস আগেও এতটা চরম অবস্থার পূর্বাভাস দেননি বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিকে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরলেও এগুলো সেই রকম ‘শুল্ক বাধা ভেঙে ফেলার’ চুক্তি নয়, যা আগের দশকগুলোতে দেখা যেত।
বিপর্যয়, বড় মন্দা, ব্যাপক বাজার ধসের মতো শঙ্কাগুলো এখন কিছুটা দূরে ঠেকছে। তবে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস-এর গ্লোবাল ম্যাক্রো ফোরকাস্টিং ডিরেক্টর বেন মে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এখনো বহুভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করার ক্ষমতা রাখে।
তিনি বলেন, ‘এই শুল্ক কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আয় সংকুচিত করছে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যদি কম পণ্য আমদানি করে, তাহলে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাবে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।’
জয়ী ও পরাজিত: জার্মানি, ভারত ও চীন
শুধু শুল্কের হার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিমাণও নির্ধারণ করে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের কথা ধরলে, যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানির ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ। তবে ক্যাপিটাল ইকোনমিকস-এর অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার অবদান মাত্র ২ শতাংশ হওয়ায়, এই শুল্কের তাৎক্ষণিক প্রভাব হয়তো খুব বড় ধরনের হবে না।
তবে জার্মানির ক্ষেত্রে খবরটা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। ১৫ শতাংশ শুল্ক তাদের প্রবৃদ্ধির হার থেকে চলতি বছরে ০.৫ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে দিতে পারে। যা বছরের শুরুতে করা পূর্বাভাসের চেয়ে অনেকটাই কম। এর মূল কারণ হলো, এই ধরনের শুল্কবৃদ্ধির ফলে জার্মানির বিশাল গাড়ি শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এমন সময় এই শুল্ক আরোপ যখন দেশটি ইতিমধ্যেই মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
আর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক সবচেয়ে অস্থির অবস্থায় রয়েছে। গত কয়েক মাসে চীনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যৎ শুল্কের আশঙ্কায় অ্যাপলসহ একাধিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এই সিদ্ধান্তে লাভবান হয় ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া স্মার্টফোনের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে।
তবে ভারত এটা জানে, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো, যারা যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের মুখোমুখি হয়, তারা অন্যান্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও আকর্ষণীয় বিকল্প জোগানদাতা হয়ে উঠতে পারে।
শুল্ক নীতি ও ট্রাম্পের রাজনৈতিক ঝুঁকি
যত সময় যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এই শুল্কনীতির প্রভাবও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। শুল্কের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে এই শঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠান আগেভাগে মার্কিন পণ্য কিনে রেখেছিল তাই চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বছরের বাকি সময়টাতে এই প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাবে।
বছরের শুরুতে যেখানে গড় শুল্কহার ছিল মাত্র ২ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাজস্বে উল্লেখযোগ্য প্রবাহ এসেছে, যা ছিল ট্রাম্পের ঘোষিত বাণিজ্যনীতির অন্যতম লক্ষ্য।
এ বছরের প্রথম সাত মাসেই আমদানি শুল্ক থেকে এসেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা মার্কিন ফেডারেল আয়ের প্রায় ৫ শতাংশ (যেখানে সাধারণত তা থাকে ২ শতাংশ-এর আশেপাশে)।
ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট আশা করছেন, পুরো বছরে শুল্ক থেকে আয় হবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। তুলনামূলকভাবে, ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র পায় প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
তবে সবচেয়ে বড় চাপ এখনো সাধারণ মার্কিন ভোক্তার কাঁধেই রয়েছে। তারা এখনো পুরোপুরি মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা পাননি, কিন্তু ইউনিলিভার, অ্যাডিডাসের মতো বড় ভোক্তা পণ্য কোম্পানিগুলো এখন খোলাখুলিভাবে বাড়তি খরচের হিসাব দিচ্ছে।
ফলে সামনে ‘স্টিকার শক’ অর্থাৎ হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রাহকদের বিস্মিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটা ভোক্তাদের ব্যয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং ট্রাম্পের প্রত্যাশিত সুদের হার কমানোর পথও আটকে দিতে পারে।
এ অবস্থায় অর্থনৈতিক চাপ ও মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ে নির্বাচনী বছর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের জন্য এটি একটি বাস্তব ও বাড়তে থাকা রাজনৈতিক ঝুঁকিতে পরিণত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও স্পষ্ট রাজনৈতিক হুমকি
সব ধরনের পূর্বাভাসেই কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকে, তবে এই মুহূর্তে যা স্পষ্ট, তা হলো, একজন এমন প্রেসিডেন্টের জন্য এটা একটি বাস্তব রাজনৈতিক হুমকি, যিনি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দাম বাড়ানোর নয়।
ট্রাম্প এবং হোয়াইট হাউজের অন্যান্য কর্মকর্তারা এখন কম আয়ের মার্কিনদের জন্য ‘রিবেট চেক’ দেওয়ার কথা ভাবছেন। বিশেষ করে সেইসব ব্লু-কলার (শ্রমজীবী) ভোটারদের জন্য, যারা তার রাজনৈতিক উত্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জটিল হতে পারে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনও প্রয়োজন হবে।
এটা আবার একধরনের পরোক্ষ স্বীকারোক্তিও বটে। শুধু অতিরিক্ত ফেডারেল রাজস্ব আসার দাবি, ব্যয় বা কর হ্রাসের ঘাটতি পূরণের যুক্তি অথবা ভবিষ্যতে দেশীয় কর্মসংস্থান ও সম্পদ তৈরির আশ্বাস দিয়ে জনগণের আস্থা রাখা রাজনৈতিকভাবে খুব একটা নিরাপদ কৌশল নয়। যখন রিপাবলিকান পার্টিকে আগামী বছরের অঙ্গরাজ্য ও কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হবে, তখন এই মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক চাপ দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
এখনো চূড়ান্ত হয়নি বহু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি
এই জটিল পরিস্থিতিতে আরও জটিলতা যোগ করছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে চুক্তি এখনও চূড়ান্ত না হওয়া। বিশেষ করে কানাডা এবং তাইওয়ানের সঙ্গে এখনও সমঝোতায় পৌঁছানো যায়নি। অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বড় বাণিজ্যিক অংশীদার মেক্সিকোর সঙ্গে আলোচনার সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এছাড়া চীনের জন্য আলাদা সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও এখনো অনির্ধারিত রয়েছে।
এ পর্যন্ত বেশ কিছু চুক্তি মৌখিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু তা এখনও লিখিত স্বাক্ষরিত হয়নি। এছাড়া ট্রাম্পের শর্তাবলীর বাস্তবায়ন কতটা এবং কীভাবে হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি নেতারা ট্রাম্পের দাবি করা শর্তাবলীর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন।
এই অনিশ্চয়তার কারণে ভবিষ্যতে বাণিজ্য সম্পর্ক কতটা স্থায়ী ও ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
হোয়াইট হাউজ ও বিভিন্ন দেশের মধ্যকার শুল্ক চুক্তি বিশ্লেষণে করে অর্থনীতিবিদ জন মে বলছেন, “‘শয়তান’ থাকে বিস্তারিত শর্তাবলীতে। আর এই বিস্তারিত শর্তাবলী এখন পর্যন্ত খুবই সীমিত বা অসম্পূর্ণ। ”
তবুও এটা স্পষ্ট যে বিশ্ব ধ্বংসাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধের প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে। এখন, যখন দেশগুলো নতুন ধরনের বাণিজ্য বাধার সঙ্গে মোকাবিলা করছে, ট্রাম্প সেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন।
তবে ইতিহাস বলছে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে ট্রাম্পের যে লক্ষ্য তা খুব বেশি সফল হবে বলে আশা করা কঠিন। আর কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দীর্ঘদিনের মার্কিন অংশীদাররা হয়তো এমন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করবে, যা তাদের আর ‘নির্ভরযোগ্য’ অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখবে না।
ট্রাম্প সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক অনন্য অবস্থানের সুবিধা নিচ্ছেন, যা বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং যেটি গড়ে তুলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধা শতকেরও বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু যদি বর্তমান শুল্ক ব্যবস্থা বিশ্ববাণিজ্যে মৌলিক পুনর্বিন্যাস শুরু করে, তাহলে তার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে না হলেও হতে পারে। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলতে কেটে যাবে বছরের পর ছর।
তবে এখন পর্যন্ত, ট্রাম্পের নির্বাচকদের হয়তো তাদের বেশির ভাগ ‘মূল্য’ নিজেই বহন করতে হবে উচ্চ মূল্য, সীমিত পছন্দ এবং ধীর প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক ফারহানা জিয়াসমিন।
গত এপ্রিল মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে, যে ঘোষণা অস্থির করে তোলে বিশ্ব অর্থনীতিকে। তারপর বেশির ভাগ শুল্ক বাস্তবায়ন স্থগিত করতে বাধ্য হন ট্রাম্প। চার মাস পর আবারও বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প। আর এই শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য চুক্তিকে নিজের সাফল্য হিসেবে অভিহিত করছেন তিনি।
ট্রাম্প কিছু বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন আর অন্যদের ওপর একতরফাভাবে শুল্ক চাপিয়েছেন। তবে এবার দেশগুলো কিছুটা প্রস্তুতই ছিল বলা যায়। এ কারণে গত এপ্রিলের মতো অস্থির অর্থনীতির দেখা মিলছে না।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করতে চান ট্রাম্প। অন্তত এই দাবিতেই শুল্ক আরোপ বাড়িয়েছেন তিনি। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নতুন রাজস্বের, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শিল্প পুনরুজ্জীবিত করার এবং দেশে শত শত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসার ও মার্কিন পণ্য কেনার চুক্তির।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন হবে বা এর নেতিবাচক ফলাফল কতটা পড়বে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এখন পর্যন্ত যা পরিষ্কার তা হলো, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগেই যেখানে বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ ধীরে ধীরে কমছিল, সেখানে ট্রাম্পের পদক্ষেপ সেটিকে রীতিমতো এক ঢেউয়ে পরিণত করেছে, যা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে। যদিও এখনো সেই পরিবর্তনের পূর্ণ প্রভাব বোঝা যায়নি। কারণ এমন পরিবর্তনে ফলাফল সামনে আসে দেরিতে।
অনেক দেশের জন্যই এই শুল্ক আরোপ একধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে এসেছে। বাণিজ্যিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তায় নতুন জোট গঠন নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ফলে, স্বল্প মেয়াদে ট্রাম্প যা ‘জয়’ হিসেবে দেখছেন, সেটি তাঁর বৃহত্তর কৌশলিক লক্ষ্যপূরণে কতটা কাজে দেবে, তা অনিশ্চিত। আর এর প্রভাব ট্রাম্পের জন্য এবং দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকার ওপর পড়তে যাচ্ছে, তা একেবারেই ভিন্ন হতে পারে।
‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’, যে সময়সীমা নিয়ে এসেছিল আতঙ্ক
আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের ক্যালেন্ডারে ১ আগস্ট তারিখটি লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত ছিল। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করো, নইলে ধ্বংসাত্মক শুল্কের মুখোমুখি হও।
হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো যখন ‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’র ঘোষণা দেন এবং ট্রাম্প নিজেও দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের আশাবাদী মন্তব্য করেন, তখন থেকেই বিশেষজ্ঞদের কাছে সময়সীমাটি অবাস্তব বলেই মনে হচ্ছিল এবং বাস্তবেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
জুলাই মাসের শেষে এসে দেখা গেছে, ট্রাম্প মাত্র এক ডজন বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা করেছেন, যার অনেকগুলোই এক-দুই পৃষ্ঠার বেশি নয়। এসব চুক্তিতে সাধারণত যেসব বিশদ ও বাধ্যবাধকতামূলক শর্ত থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
এই পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য অংশীদারদের অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। প্রশ্ন থেকে গেছে চুক্তিগুলোর ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিয়ে।
প্রথম ধাক্কা লেগেছিল যুক্তরাজ্যে
ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সেই ঘাটতি তুলনামূলকভাবে প্রায় ভারসাম্যপূর্ণ। ফলে যুক্তরাজ্যের বেলায় দ্রুত অগ্রগতি হওয়াটা খুব একটা বিস্ময়ের নয়।
বেশির ভাগ ব্রিটিশ পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ প্রাথমিক শুল্কহার আরোপ প্রথমে কিছুটা কপাল কুঁচকানোর মতো ছিল ঠিকই, তবে সেটিই পরবর্তী পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটিও কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের মতো অংশীদারদের ওপর যেখানে শুল্ক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি যথাক্রমে ২৪০ বিলিয়ন ডলার ও ৭০ বিলিয়ন ডলার (শুধু গত বছরে) সেখানে যুক্তরাজ্যের হার ছিল তুলনামূলক সহনীয়।
তবে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের এসব চুক্তি শর্তহীন ছিল না। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কেনার বিষয়ে স্পষ্ট অঙ্গীকার দিতে পারেনি, তারা অনেক সময় উচ্চ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক দেশকে শুল্ক চিঠি পাঠাতে থাকে। বর্তমানে বেশির ভাগ আমদানি যুক্তরাষ্ট্রে এখন কোনো না কোনো চুক্তি বা প্রেসিডেন্টের একতরফা আদেশের আওতায় পড়ে আর এসব আদেশের শেষে থাকে ট্রাম্পের সংক্ষিপ্ত বার্তা: ‘এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘ক্ষতি’ করার ক্ষমতা
গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ অনেক কিছু উন্মোচন করেছে। তবে ভালো খবর হলো শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ শুল্ক এবং মন্দার আশঙ্কা এড়ানো গেছে। উচ্চ শুল্কহার এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন শুল্ক শর্তে সম্মত হওয়ায় একটা বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। যে অনিশ্চয়তা ট্রাম্প নিজেই গত মাসগুলোতে একধরনের অর্থনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় একদিকে যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় পরিকল্পনা করতে পারছে, তেমনি বিনিয়োগ ও নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও আবার সচল হচ্ছে।
বেশিরভাগ রপ্তানিকারক এখন জানেন, তাদের পণ্যের ওপর কত শতাংশ শুল্ক বসছে এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা খরচ কীভাবে সামলাবেন বা ভোক্তার ওপর কতটা চাপ দেবেন, সেটাও হিসাব করতে পারছেন।
এই ক্রমবর্ধমান স্পষ্টতা বিশ্ব অর্থবাজারে তুলনামূলক স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য একটি দিক থেকে এটি নেতিবাচকও বটে। কারণ এখন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির গড় শুল্কহার আগের তুলনায় বেশি এবং ছয় মাস আগেও এতটা চরম অবস্থার পূর্বাভাস দেননি বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিকে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরলেও এগুলো সেই রকম ‘শুল্ক বাধা ভেঙে ফেলার’ চুক্তি নয়, যা আগের দশকগুলোতে দেখা যেত।
বিপর্যয়, বড় মন্দা, ব্যাপক বাজার ধসের মতো শঙ্কাগুলো এখন কিছুটা দূরে ঠেকছে। তবে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস-এর গ্লোবাল ম্যাক্রো ফোরকাস্টিং ডিরেক্টর বেন মে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এখনো বহুভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করার ক্ষমতা রাখে।
তিনি বলেন, ‘এই শুল্ক কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আয় সংকুচিত করছে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যদি কম পণ্য আমদানি করে, তাহলে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাবে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।’
জয়ী ও পরাজিত: জার্মানি, ভারত ও চীন
শুধু শুল্কের হার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিমাণও নির্ধারণ করে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের কথা ধরলে, যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানির ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ। তবে ক্যাপিটাল ইকোনমিকস-এর অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার অবদান মাত্র ২ শতাংশ হওয়ায়, এই শুল্কের তাৎক্ষণিক প্রভাব হয়তো খুব বড় ধরনের হবে না।
তবে জার্মানির ক্ষেত্রে খবরটা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। ১৫ শতাংশ শুল্ক তাদের প্রবৃদ্ধির হার থেকে চলতি বছরে ০.৫ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে দিতে পারে। যা বছরের শুরুতে করা পূর্বাভাসের চেয়ে অনেকটাই কম। এর মূল কারণ হলো, এই ধরনের শুল্কবৃদ্ধির ফলে জার্মানির বিশাল গাড়ি শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এমন সময় এই শুল্ক আরোপ যখন দেশটি ইতিমধ্যেই মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
আর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক সবচেয়ে অস্থির অবস্থায় রয়েছে। গত কয়েক মাসে চীনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যৎ শুল্কের আশঙ্কায় অ্যাপলসহ একাধিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এই সিদ্ধান্তে লাভবান হয় ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া স্মার্টফোনের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে।
তবে ভারত এটা জানে, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো, যারা যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের মুখোমুখি হয়, তারা অন্যান্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও আকর্ষণীয় বিকল্প জোগানদাতা হয়ে উঠতে পারে।
শুল্ক নীতি ও ট্রাম্পের রাজনৈতিক ঝুঁকি
যত সময় যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এই শুল্কনীতির প্রভাবও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। শুল্কের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে এই শঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠান আগেভাগে মার্কিন পণ্য কিনে রেখেছিল তাই চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বছরের বাকি সময়টাতে এই প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাবে।
বছরের শুরুতে যেখানে গড় শুল্কহার ছিল মাত্র ২ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাজস্বে উল্লেখযোগ্য প্রবাহ এসেছে, যা ছিল ট্রাম্পের ঘোষিত বাণিজ্যনীতির অন্যতম লক্ষ্য।
এ বছরের প্রথম সাত মাসেই আমদানি শুল্ক থেকে এসেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা মার্কিন ফেডারেল আয়ের প্রায় ৫ শতাংশ (যেখানে সাধারণত তা থাকে ২ শতাংশ-এর আশেপাশে)।
ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট আশা করছেন, পুরো বছরে শুল্ক থেকে আয় হবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। তুলনামূলকভাবে, ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র পায় প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
তবে সবচেয়ে বড় চাপ এখনো সাধারণ মার্কিন ভোক্তার কাঁধেই রয়েছে। তারা এখনো পুরোপুরি মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা পাননি, কিন্তু ইউনিলিভার, অ্যাডিডাসের মতো বড় ভোক্তা পণ্য কোম্পানিগুলো এখন খোলাখুলিভাবে বাড়তি খরচের হিসাব দিচ্ছে।
ফলে সামনে ‘স্টিকার শক’ অর্থাৎ হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রাহকদের বিস্মিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটা ভোক্তাদের ব্যয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং ট্রাম্পের প্রত্যাশিত সুদের হার কমানোর পথও আটকে দিতে পারে।
এ অবস্থায় অর্থনৈতিক চাপ ও মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ে নির্বাচনী বছর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের জন্য এটি একটি বাস্তব ও বাড়তে থাকা রাজনৈতিক ঝুঁকিতে পরিণত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও স্পষ্ট রাজনৈতিক হুমকি
সব ধরনের পূর্বাভাসেই কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকে, তবে এই মুহূর্তে যা স্পষ্ট, তা হলো, একজন এমন প্রেসিডেন্টের জন্য এটা একটি বাস্তব রাজনৈতিক হুমকি, যিনি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দাম বাড়ানোর নয়।
ট্রাম্প এবং হোয়াইট হাউজের অন্যান্য কর্মকর্তারা এখন কম আয়ের মার্কিনদের জন্য ‘রিবেট চেক’ দেওয়ার কথা ভাবছেন। বিশেষ করে সেইসব ব্লু-কলার (শ্রমজীবী) ভোটারদের জন্য, যারা তার রাজনৈতিক উত্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জটিল হতে পারে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনও প্রয়োজন হবে।
এটা আবার একধরনের পরোক্ষ স্বীকারোক্তিও বটে। শুধু অতিরিক্ত ফেডারেল রাজস্ব আসার দাবি, ব্যয় বা কর হ্রাসের ঘাটতি পূরণের যুক্তি অথবা ভবিষ্যতে দেশীয় কর্মসংস্থান ও সম্পদ তৈরির আশ্বাস দিয়ে জনগণের আস্থা রাখা রাজনৈতিকভাবে খুব একটা নিরাপদ কৌশল নয়। যখন রিপাবলিকান পার্টিকে আগামী বছরের অঙ্গরাজ্য ও কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হবে, তখন এই মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক চাপ দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
এখনো চূড়ান্ত হয়নি বহু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি
এই জটিল পরিস্থিতিতে আরও জটিলতা যোগ করছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে চুক্তি এখনও চূড়ান্ত না হওয়া। বিশেষ করে কানাডা এবং তাইওয়ানের সঙ্গে এখনও সমঝোতায় পৌঁছানো যায়নি। অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বড় বাণিজ্যিক অংশীদার মেক্সিকোর সঙ্গে আলোচনার সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এছাড়া চীনের জন্য আলাদা সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও এখনো অনির্ধারিত রয়েছে।
এ পর্যন্ত বেশ কিছু চুক্তি মৌখিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু তা এখনও লিখিত স্বাক্ষরিত হয়নি। এছাড়া ট্রাম্পের শর্তাবলীর বাস্তবায়ন কতটা এবং কীভাবে হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি নেতারা ট্রাম্পের দাবি করা শর্তাবলীর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন।
এই অনিশ্চয়তার কারণে ভবিষ্যতে বাণিজ্য সম্পর্ক কতটা স্থায়ী ও ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
হোয়াইট হাউজ ও বিভিন্ন দেশের মধ্যকার শুল্ক চুক্তি বিশ্লেষণে করে অর্থনীতিবিদ জন মে বলছেন, “‘শয়তান’ থাকে বিস্তারিত শর্তাবলীতে। আর এই বিস্তারিত শর্তাবলী এখন পর্যন্ত খুবই সীমিত বা অসম্পূর্ণ। ”
তবুও এটা স্পষ্ট যে বিশ্ব ধ্বংসাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধের প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে। এখন, যখন দেশগুলো নতুন ধরনের বাণিজ্য বাধার সঙ্গে মোকাবিলা করছে, ট্রাম্প সেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন।
তবে ইতিহাস বলছে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে ট্রাম্পের যে লক্ষ্য তা খুব বেশি সফল হবে বলে আশা করা কঠিন। আর কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দীর্ঘদিনের মার্কিন অংশীদাররা হয়তো এমন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করবে, যা তাদের আর ‘নির্ভরযোগ্য’ অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখবে না।
ট্রাম্প সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক অনন্য অবস্থানের সুবিধা নিচ্ছেন, যা বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং যেটি গড়ে তুলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধা শতকেরও বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু যদি বর্তমান শুল্ক ব্যবস্থা বিশ্ববাণিজ্যে মৌলিক পুনর্বিন্যাস শুরু করে, তাহলে তার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে না হলেও হতে পারে। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলতে কেটে যাবে বছরের পর ছর।
তবে এখন পর্যন্ত, ট্রাম্পের নির্বাচকদের হয়তো তাদের বেশির ভাগ ‘মূল্য’ নিজেই বহন করতে হবে উচ্চ মূল্য, সীমিত পছন্দ এবং ধীর প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক ফারহানা জিয়াসমিন।
গত এপ্রিলে ‘লিবারেশন ডে’ ঘোষণা দিয়ে বিশ্বজুড়ে শুল্ক আরোপ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এশিয়ার অর্থনীতি। দীর্ঘদিনের পুরোনো মার্কিন মিত্র জাপান থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান জোটের দেশগুলোসহ যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর নির্ভরশ
১৫ ঘণ্টা আগেবিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে দ্রুত উত্থান, মার্কিন কৌশলগত নীতির কারণে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ওয়াশিংটনের কাছে দিল্লির একটা আলাদা গুরুত্ব সব সময়ই ছিল। এতে ভারতের আত্মবিশ্বাস ও আঞ্চলিক প্রভাব অনেক বেড়েছে। বিশ্বমঞ্চে ভারতের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রবল আত্মবিশ্ব
১ দিন আগে‘বাসুধৈব কুটুম্বকম’—বিশ্ব একটি পরিবার, এই মহৎ বার্তা দিয়েই ভারত নিজ দেশে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের সামনে নিজ দেশের দর্শন তুলে ধরেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একটি জাতিকে নির্মূল করার যুদ্ধে মদদ দিয়ে, যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমন করে, এমনকি শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণকারী এক...
৩ দিন আগেমিয়ানমারের বিরল খনিজ সম্পদের দিকে চোখ পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মিয়ানমারের বিরল খনিজে চীনের কর্তৃত্ব সরিয়ে নিতে এবার ট্রাম্প প্রশাসন হাত মেলাচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। এমনকি দেশটির ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলোতে আসছে শিথিলতা, হচ্ছে প্রত্যাহারও।
৪ দিন আগে