Ajker Patrika

চুক্তি স্বাক্ষর হলো, হামাসও গাজায় ফিরল, এরপর কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ১২
গত ১০ অক্টোবর দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভবনগুলোর পাশে শিশু কোলে এক নারী অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। ছবি: এএফপি
গত ১০ অক্টোবর দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভবনগুলোর পাশে শিশু কোলে এক নারী অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। ছবি: এএফপি

গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ বন্ধ, জিম্মি-বন্দিবিনিময় এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বনেতারা। এর আগে হামাস এবং ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কাতার, তুরস্ক, মিসর, পাকিস্তান, জর্ডানের নেতারাও এই চুক্তিতে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে আপাতত গাজায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের অবসান হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির একটি কপি পেয়েছে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই। ইসরায়েল, হামাস ও মিসরে মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত সেই চুক্তির মাধ্যমে গাজায় গণহত্যা বন্ধের সমঝোতা হয়েছে।

নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফসহ একাধিক মধ্যস্থতাকারীর স্বাক্ষর রয়েছে। চুক্তির শিরোনাম—‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের “গাজা যুদ্ধের স্থায়ী অবসান” প্রস্তাব বাস্তবায়নের ধাপসমূহ’। নথিতে ছয়টি ধাপ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেবেন যে গাজার যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যুদ্ধ অবসানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপে বলা আছে, ‘ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদনের পরই যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে শেষ হবে।’ ইসরায়েলের সরকার বৃহস্পতিবার এই চুক্তির প্রথম ধাপ অনুমোদন করেছে। তৃতীয় ধাপে বলা হয়েছে, ‘মানবিক সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রীর পূর্ণ প্রবেশ সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে।’ চতুর্থ ধাপে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) সংযুক্ত মানচিত্র অনুযায়ী সম্মত সীমারেখায় পিছু হটবে, যা ট্রাম্পের ঘোষণার পর ও ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হবে।’

সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত হামাস এই চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করবে, আইডিএফ ওই প্রত্যাহার করা এলাকাগুলোতে আর ফিরবে না।’ পঞ্চম ধাপে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় আটক সব ইসরায়েলি জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) মুক্তি দেওয়া হবে।’ এই ধাপের এক উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যেসব মৃত জিম্মির মরদেহ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তাদের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। একই ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলে আটক মৃত ফিলিস্তিনিদের দেহাবশেষ সম্পর্কেও তথ্য বিনিময় করা হবে।’

এতে আরও বলা হয়, ‘এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে, সব জিম্মির মরদেহ নিরাপদে উদ্ধার ও হস্তান্তর করা হয়েছে। হামাস যত দ্রুত সম্ভব এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবে।’ পরবর্তী উপধারায় বলা হয়েছে, ‘হামাস যত জিম্মি মুক্তি দেবে, ইসরায়েলও সমানসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে, যা সংযুক্ত তালিকা অনুযায়ী সম্পন্ন হবে।’

আরও একটি উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জিম্মি ও বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়া মধ্যস্থতাকারী ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) মাধ্যমে সম্পন্ন হবে কোনো প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বা গণমাধ্যম কাভারেজ ছাড়াই।’ শেষ ধাপে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর, তুরস্ক ও অন্যান্য সম্মত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, যারা চুক্তির বাস্তবায়ন তদারকি করবে এবং দুই পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করবে।’

ট্রাম্পের ‘গাজা যুদ্ধের স্থায়ী অবসান’ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ধাপসমূহ

১. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেবেন যে গাজার যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যুদ্ধ অবসানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে।

২. ইসরায়েলের সরকারের অনুমোদনের পর যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে শেষ হবে। সব ধরনের সামরিক অভিযান—বিমান ও গোলাবর্ষণসহ টার্গেটিং অপারেশন স্থগিত থাকবে। আইডিএফ যেসব এলাকা থেকে পিছু হটবে, সেই এলাকাগুলোয় ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত আকাশ পর্যবেক্ষণ বন্ধ থাকবে।

৩. মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু হবে। এটি ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির মানবিক সহায়তা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ত্রাণ সরবরাহের বিস্তারিত পদক্ষেপ সংযুক্ত করা হয়েছে।

৪. আইডিএফ সংযুক্ত মানচিত্র অনুযায়ী নির্ধারিত সীমারেখায় পিছু হটবে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর এবং ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে। হামাস পুরো চুক্তি বাস্তবায়ন করলে আইডিএফ আর ওই এলাকাগুলোয় ফিরে যাবে না।

৫. ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় আটক সব ইসরায়েলি জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) মুক্তি দেওয়া হবে (সংযুক্ত তালিকা অনুযায়ী)।

ক. আইডিএফ প্রত্যাহার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামাস সব জিম্মির অবস্থার তদন্ত শুরু করবে ও প্রাপ্ত তথ্য মধ্যস্থতাকারী ও আইসিআরসির মাধ্যমে জানাবে। ইসরায়েল গাজা থেকে আটক ফিলিস্তিনি বন্দীদের বিষয়ে তথ্য দেবে।

খ. ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাস জীবিত সব জিম্মিকে মুক্তি দেবে, গাজায় সব ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর হেফাজতে থাকা জিম্মিসহ।

গ. একই সময়ের মধ্যে হামাস মৃত জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেবে।

ঘ. হামাস যেসব মৃত জিম্মির বিষয়ে তথ্য পাবে, তা নির্ধারিত তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থার মাধ্যমে জানাবে। ইসরায়েলও গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের মরদেহ সম্পর্কিত তথ্য দেবে।

ঙ. মধ্যস্থতাকারী ও আইসিআরসির মাধ্যমে একটি তথ্য বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যাতে উদ্ধার না হওয়া জিম্মিদের মরদেহ ও ইসরায়েলে আটক গাজাবাসীর দেহাবশেষ সম্পর্কে তথ্য বিনিময় সম্ভব হয়। হামাস যত দ্রুত সম্ভব এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

চ. হামাস যত জিম্মি মুক্তি দেবে, ইসরায়েলও সমানসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে (সংযুক্ত তালিকা অনুযায়ী)।

ছ. জিম্মি ও বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়া মধ্যস্থতাকারী ও আইসিআরসির মাধ্যমে গোপনে সম্পন্ন হবে, কোনো প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বা সংবাদ কাভারেজ ছাড়াই।

৬. যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর, তুরস্ক ও অন্য সম্মত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, যা দুই পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে চুক্তির বাস্তবায়ন তদারকি করবে।

এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর গাজা উপত্যকার আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে মাঠে নেমেছে হামাস। স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সকাল থেকে অঞ্চলটির বিভিন্ন অংশে সশস্ত্র যোদ্ধা ও পুলিশ মোতায়েন করেছে সংগঠনটি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে, দক্ষিণ গাজার এক হাসপাতালে ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির সময় হামাস যোদ্ধারা পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে। একই সঙ্গে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের খবরও পাওয়া গেছে। হামাস-সম্পৃক্ত টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো বলেছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ‘সহযোগী ও বিশ্বাসঘাতক’ স্থানীয় মিলিশিয়ারা।

তবে হামাসের এই অবস্থান বর্তমান যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে হুমকির মুখে ফেলবে না বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এতে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজায় মোতায়েন হতে যাওয়া আঞ্চলিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজ নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হামাস আসলে ‘যুদ্ধবিরতির সীমার মধ্যেই’ কাজ করছে।

ট্রাম্প বলেন, ‘তারা সমস্যাগুলো বন্ধ করতে চায়, এ বিষয়ে তারা খোলামেলা। আমরা তাদের কিছু সময়ের অনুমতি দিয়েছি...প্রায় ২০ লাখ মানুষ ভেঙে যাওয়া ভবনে ফিরে যাচ্ছে। এতে নানা ঝুঁকি আছে। আমরা চাই পরিস্থিতি নিরাপদ থাকুক। আমার মনে হয়, ঠিকই থাকবে; তবে নিশ্চিতভাবে কে বলতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত