Ajker Patrika

থাইল্যান্ডের সংসদীয় গণতন্ত্র কি হুমকির মুখে

হুসাইন আহমদ
প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা
প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা

থাইল্যান্ডে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘনীভূত হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার দেশটির সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। একটি ফোনালাপ ফাঁসের জের ধরে ৩৮ বছর বয়সী এই নেত্রীর বিরুদ্ধে অসততা ও নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়েছে।

থাইল্যান্ডের ৩৬ জন সেনেটর আদালতের কাছে দাবি করেন, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে পেতংতার্ন কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে সীমান্ত-সংকট মোকাবিলায় আপোষমূলক প্রতিশ্রুতি দেন, যা তাঁর পদে থাকার উপযুক্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই ঘটনার পর গত শনিবার ব্যাংককের ভিক্টরি মনুমেন্ট এলাকায় অন্তত ১০ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে পেটংতার্নের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করে। ২০২৩ সালে পেতংতার্নের দল পিউ থাই পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ এটি।

এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন সেইসব পুরনো মুখ যাঁরা পেতংতার্নের বাবা থাকসিন ও ফুপু ইংলাক সিনাওয়াত্রার বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ‘রুয়াম পালাং পেন দিন পক পং আথিপাতাই’ নামে গঠিত নতুন এই জোট মূলত অতিজাতিবাদী রাজনৈতিক স্লোগানে বিক্ষোভ চালাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন বরখাস্ত হওয়ার পর বর্তমান পরিবহন মন্ত্রী ও উপ–প্রধানমন্ত্রী সুরিয়া জুয়াংরুয়াংকিত অন্তর্বর্তী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ৭০ বছর বয়সী সুরিয়া নব্বই দশক থেকে থাই রাজনীতিতে সক্রিয়, বিভিন্ন দলে থেকে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব পালন করেছেন।

সাংবিধানিক আদালত জানিয়েছে, পেটংতার্নকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ১৫ দিনের মধ্যে অভিযোগের লিখিত জবাব জমা দিতে হবে। এরপর আদালত পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হবে।

এদিকে মঙ্গলবারই ঘোষিত মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনে পেটংতার্নকে নতুন সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। আগামী ৩ জুলাই শপথ গ্রহণের পর তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিতে পারবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।

আগামী ৩ জুলাই থাইল্যান্ডের পার্লামেন্ট বসবে। এর আগেই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ভূমজাইথাই পার্টি। তবে সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্তের পর আপাতত এই পদক্ষেপ স্থগিত। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ছাড়া অনাস্থা সফল হবে না।

৩৬ সেনেটর যে ফোনালাপের ভিত্তিতে আদালতে আবেদন করেছেন, সেই একই বিষয়ে দেশটির দুর্নীতিরবিরোধী সংস্থা ন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কমিশন–এনএসিসি তদন্ত শুরু করেছে। এই তদন্ত থাইল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে, যার ফলে পেতংতার্নের রাজনীতি নিষিদ্ধও হতে পারে।

এই সংকট কেবল একজন নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নয়, বরং গোটা থাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে ব্যাংকক পোস্টের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে সতর্ক করে বলা হয়, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ যেভাবে হচ্ছে, তা শুধুমাত্র অতীতের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। ২০০৬ ও ২০১৪ সালে থাকসিন ও ইংলাকের বিরুদ্ধে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল এবং তার জেরে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল। এবারো যদি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়, তবে তা হবে থাই গণতন্ত্রের জন্য গভীর হুমকি।

বিশেষত, বর্ষীয়ান নেতা সোন্থি লিমথংকুলের বক্তব্যকে উদ্বেগজনক হিসেবে তুলে ধরেছে ব্যাংকক পোস্ট। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কোনোকিছু করলেও তিনি তাতে বাধা দেবেন না। সীমান্ত নিয়ে তাঁর কঠোর বক্তব্যও জাতীয়তাবাদী উসকানিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

এমন বক্তব্যের কারণে শাসক ও বিরোধী— উভয় পক্ষ থেকেই প্রতিবাদ এসেছে। যদিও আন্দোলনকারীরা পরে এক বিবৃতিতে ‘সেনা হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন না’ বলে দাবি করেছেন, তবে রাজনৈতিক আস্থা নষ্টের ক্ষেত্রে এই ধরনের রেটোরিককে ধ্বংসাত্মক বলে অভিহিত করেছে ব্যাংকক পোস্ট।

বর্তমান সংকট শুধু একটি সরকার পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়। বরং থাইল্যান্ডের গণতান্ত্রিক কাঠামো কতটা স্থিতিশীল, সেটির বড় পরীক্ষা এটি। যদি রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনপ্রতিনিধিরা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন, তাহলে রাজপথই আবার হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক নির্ধারণের একমাত্র স্থান। এবং সেক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আবার সামরিক হস্তক্ষেপ অসম্ভব নয়। এমন বাস্তবতা গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত