Ajker Patrika

টিআরটি গ্লোবালের নিবন্ধ

সার্কের সমাধিতে চীন-পাকিস্তানের নেতৃত্বে নয়া আঞ্চলিক জোটের পদধ্বনি

অনলাইন ডেস্ক
সার্কের বিকল্প আঞ্চলিক জোট নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক তোড়জোড়। ছবি: সংগৃহীত
সার্কের বিকল্প আঞ্চলিক জোট নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক তোড়জোড়। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়া ও চীনকে নিয়ে নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনের পরিকল্পনা চলমান। পাকিস্তান, চীন ও প্রতিবেশী অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলেছে। এখানে অবশ্য ভারতের অবস্থান কী হবে সে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

আঞ্চলিক সমন্বয়ের জন্য নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম জরুরি—এই বিষয়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোর একটি সাধারণ বিশ্বাসই এই জোট গঠনের উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করেছে। চীন ও পাকিস্তান এরই মধ্যে মূল অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে, যা এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও চীন এখনো এই জোটের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি, কিন্তু কূটনৈতিক আলোচনা নির্দেশ করে যে, বেইজিং এই জোটকে বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ভিশন অর্জনের যোগ্য করে গড়ে তুলতে চায়।

প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলো বলছে যে, নয়া এই জোট বর্তমানে কার্যত অকার্যকর দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) জায়গা নিতে চায়। এই জোটের মূল ফোকাসের জায়গাগুলো হবে বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক সংযোগ। এ ছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে জরুরি হয়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান সীমান্ত সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেও নজর দেবে এই জোট। আর এই ধারণা মূলত দৃষ্টি আকর্ষণ করে গত ৯ জুন চীনের কুনমিংয়ে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যকার এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর।

এই বৈঠক ছিল নয়া আঞ্চলিক জোট গঠনের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নয়া এই জোট স্থবির হয়ে পড়া সার্কের কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের আগের সরকার ভারতের সার্ক বয়কটকে সমর্থন করলেও নতুন সরকার এখন সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখাচ্ছে। সার্কভুক্ত বেশ কিছু দেশ, যেমন—শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান, এই নতুন উদ্যোগে যোগ দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারতকেও এই নতুন কাঠামোতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে, তবে পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার কারণে ভারতের এতে অংশগ্রহণের আগ্রহ এখনো অনিশ্চিত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু ‘অনিশ্চিত’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই সংস্থার নাম হতে পারে ‘সাউথ এশিয়ান কো-অপারেশন অ্যালায়েন্স’ বা সাকা, যার প্রাথমিক বৈঠক আগস্টে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্কের সদর দপ্তর নেপালের কাঠমাণ্ডুতে। সংস্থাটি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গঠিত হয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপ ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কে যোগ দেয়।

সার্কের অধীনে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (সাফটা), সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর প্রভাব সীমিতই ছিল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছিল মোট বাণিজ্যের মাত্র পাঁচ শতাংশ—যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তা ৬৫ শতাংশ এবং আসিয়ান অঞ্চলে ২৬ শতাংশ।

দু শ কোটির কাছাকাছি মানুষের এই অঞ্চলে সার্কের গুরুত্ব ছিল দেশগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে ছোট দেশগুলোকেও নিজেদের উদ্বেগ ও সমাধানের সুযোগ দেওয়ার মধ্যে। তবে প্রায় এক দশক ধরে কোনো শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ায় সার্ক কার্যত বিলুপ্তির পথে। এই শূন্যতার মধ্যেই গঠিত হতে চলেছে চীন-পাকিস্তান নেতৃত্বাধীন নতুন কাঠামো।

সার্কের পতনের সূচনা ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় ১৯ তম শীর্ষ সম্মেলন থেকে, যার আয়োজক ছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু ভারতের কাশ্মীরের উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনার পর ইসলামাবাদের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ে এবং ভারত সম্মেলন বয়কট করে। এই বয়কটের পক্ষে অবস্থান নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের তৎকালীন ভারত ঘনিষ্ঠ সরকার। একটি মাত্র দেশের বিরোধিতায় সার্কের যৌথ অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়—বিশেষ করে বাণিজ্য, জলবায়ু অভিযোজন ও মানব উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে।

ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, বিশেষ করে কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদ ও পানি ভাগাভাগি নিয়ে, কূটনৈতিক অচলাবস্থার জন্ম দিয়েছে বারবার। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশটি হিন্দুত্ববাদী আদর্শ গ্রহণ করে, যা পাকিস্তানকে আরও কোণঠাসা করে তোলে এবং সার্ককে অকার্যকর করে দেয়।

সার্ক পুনরুজ্জীবনের বদলে ভারত মনোযোগ দেয় বিমসটেকের (BIMSTEC) দিকে, যেখানে পাকিস্তান নেই। তবে এই প্ল্যাটফর্মও সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসাম্যতার কারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ভারত পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের জন্য সার্ক ভিসা বাতিল করে, যা অনেকের মতে সার্কের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।

যেকোনো ফোরামে পাকিস্তান উপস্থিত থাকলে ভারত সেটিকে রাজনীতিকীকরণ করে ফেলে—এমন প্রবণতা আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মগুলোর সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে। সম্প্রতি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনেও দেখা গেছে, একমাত্রা দেশ হিসেবে ভারত সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। এতে স্পষ্ট হয়েছে, ভারত এখন আর যৌথ উদ্যোগে আগ্রহী নয়।

একসময় দক্ষিণ এশিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলে খ্যাত সার্কের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কোনো শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা অভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সার্কে কখনই ছিল না। ইইউ তৈরি হয়েছিল যুদ্ধোত্তর সময়ে আর্থিক পুনর্গঠন ও পুনর্মিলনের ভিত্তিতে। অথচ সার্ক গড়ে উঠেছিল দীর্ঘদিনের শত্রুতা, সীমান্ত বিরোধ এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে।

এই দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা বারবার সার্কের বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। ইইউ যেখানে শক্তিশালী সর্বোচ্চ কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে, সার্ক ছিল কেবল রাষ্ট্রভিত্তিক সহযোগিতার একটি ছায়ামাত্র—যেখানে সবকিছুই ছিল ঐকমত্যনির্ভর, কোনো বাধ্যবাধকতা বা জবাবদিহি ছিল না। এর ফলে, রাজনৈতিক পরিবর্তন বা দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েন সার্ককে সহজেই অকার্যকর করে দিতে পেরেছে। এর পাশাপাশি ভারতের আকার ও অর্থনৈতিক প্রভাবও একটি একতাবদ্ধ আঞ্চলিক এজেন্ডা তৈরির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আঞ্চলিক বড় শক্তি হিসেবে চীন, ভারতের প্রভাবকে ভারসাম্য করতে পারে। এতে পুরোনো কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুটা পেছনে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হবে। সার্ক নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগে পাকিস্তান প্রস্তাব দিয়েছিল, নতুন সদস্য হিসেবে চীন, ইরান ও মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার। এমনকি ১৯ তম সম্মেলনে চীনকে নবম সদস্য করার প্রস্তাবও দিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ভারতের বয়কটের কারণে সেই সম্মেলনই বাতিল হয়ে যায়।

বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম কম সংহত অঞ্চল। এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় দেশগুলোকে একত্রে ধরে রাখার জন্য কার্যকর কোনো প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন অনেক দিন ধরেই অনুভূত হচ্ছে। যদি চীন, পাকিস্তান ও অন্যান্য সম্ভাব্য সদস্য দেশগুলো একটি কার্যকর বাণিজ্যভিত্তিক কাঠামো নিয়ে একমত হতে পারে, তাহলে নতুন এই সংস্থাটি একটি শক্ত আঞ্চলিক জোটে রূপ নিতে পারে।

ভারতের জন্য এই আমন্ত্রণ এক মোড় পরিবর্তনের সুযোগ। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ভারত কি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনে অংশ নেবে, না কি এক নতুন আঞ্চলিক শৃঙ্খলা গঠনের পথ শুধু দূর থেকে তাকিয়ে দেখবে।

টিআরটি গ্লোবাল থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত