Ajker Patrika

ইন্টারনেট যাত্রার ২৯ বছর

নারীদের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও হুমকি

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

১৯৯৩ সালে সীমিত আকারে চালু হলেও বাংলাদেশে সবার জন্য ইন্টারনেট উন্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। ২৯ বছরের এই যাত্রায় স্মার্টফোন ও ওয়াই-ফাইয়ের কল্যাণে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে প্রায় প্রতিটি ঘরে। শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সিং, ব্যবসা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এর পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নারীদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি, মানসিক চাপ এবং সৌন্দর্যবিষয়ক অস্থিরতা। এগুলো প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রায় তিন দশকের এই যাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীদের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও হুমকি বিষয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

স্বাবলম্বী ও সাইবার হুমকি

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তা তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গ্রামাঞ্চলে কম হলেও শহরাঞ্চলে এই প্রবণতা বাড়ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের সংখ্যা কত, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান জানা যায় না। অনেক নারী ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স ও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নিজের অবস্থান গড়তে পেরেছেন। তাঁরা উদ্যোক্তা, ডিজিটাল অ্যাকটিভিস্ট, এমনকি রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্রেও সক্রিয়। কিন্তু সাইবার হুমকির ছায়া সব সময় তাঁদের পেছনে। বিষয়গুলো কেমন?

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘অনলাইন হ্যারাসমেন্ট, রিভেঞ্জ পর্নো, সাইবার স্টকিং এবং ফেক আইডির মাধ্যমে অপপ্রচারে নারীরা বিপদে পড়ছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় নারীরা বেশি টার্গেট হচ্ছেন।’

প্রতিনিয়ত কমেন্ট বক্সে বুলিং এবং আক্রমণ থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে নারীদের হেয় করা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের বিপক্ষে মতাদর্শ গড়ে তোলার চেষ্টা করে একদল মানুষ। এ থেকে রক্ষার জন্য নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সাইবার বুলিং প্রতিরোধে নারীদের জন্য একটি ইউনিট গঠনের কথা বলেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়া ও সৌন্দর্য চাপ

ইন্টারনেটের এক অনিবার্য অংশ সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্ল্যাটফর্মগুলো নারীদের ওপর তৈরি করছে ‘পারফেক্ট সৌন্দর্যে’র চাপ। রূপবিশেষজ্ঞ শারমিন কচি বলেন, ‘ক্লায়েন্টরা এখন রেফারেন্স ছবি নিয়ে আসেন—কারিনা কাপুরের বিয়ের লুক চাই।’ তিনি জানান, লুক যে শুধু মেকআপের বিষয় নয়, পোশাকসহ পুরো বিষয়টিই একটি প্যাকেজ, ক্লায়েন্টরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন না। ফলে

এই অসম সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। বাড়ছে ডিপ্রেশন, বডি ডিসমরফিয়া ও আত্মমূল্যায়নের ঘাটতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল লুক বা ট্রেন্ডি মেকআপ যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে নারীদের।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, ‘আমাদের আচরণ, ফ্যাশন সেন্স, এমনকি মূল্যবোধও আজ সামাজিক মাধ্যম দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।’ এই চাপ নারীদের লাবণ্য ও আবেদনময়ী হয়ে উঠতে বেশি উৎসাহ দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত। তিনি বলেন, ‘নারী প্রতি মুহূর্তে সচেতন থাকে নিখুঁত হতে। এই চরম অবমাননাকর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে বিষাদগ্রস্ত, হতাশা অথবা অহমে নিমজ্জিত করে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’

নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক অধিকার

দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডিজিটাল কোনো মাধ্যমে কথা বলা এখনো নিরাপত্তাহীন; বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। সীমা দত্ত বলেন, ‘ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্য পাওয়া সহজলভ্য হওয়ায় নারীরাও এর সুফল পাচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বক্তব্য, তা প্রতিক্রিয়াশীল কি প্রগতিশীল যা-ই হোক, নারীরা তার অংশীদার হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেটকে তারা আয়ের পথ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। চব্বিশের গণ-আন্দোলনেও নারীদের নানান অনুপ্রেরণাদায়ক আয়োজন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে এসেছে।’

সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্ম নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘নারী অধিকার, ভোটাধিকার, আইনি সুরক্ষা নিয়ে অনেকে আজ নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন। অনেক নারী এখন ডিজিটাল অ্যাকটিভিস্ট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য আশাব্যঞ্জক।’

গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহার

তানভীর হাসান জোহা বলেছেন, ‘শহরের নারীরা তুলনামূলকভাবে প্রযুক্তির সুযোগ পেলেও গ্রামীণ নারীরা এখনো সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন বাধার মুখে রয়েছেন। অনেকে প্রযুক্তি বিষয়টি এখনো “ছেলেদের বিষয়” মনে করেন। মোবাইল ফোন ব্যবহারে মেয়েদের প্রতি সন্দেহ ও নজরদারি চলে।’ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম এবং নারী নেতৃত্বে পরিচালিত টেক ক্লাব চালু করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে সীমা দত্ত বলেন, ‘নারীরা কেন ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, এ রকম মনোভাব পোষণ করে গ্রামীণ মুরব্বিরা। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও আছে। ঘর-সংসার সামলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করে না অনেকে।’

কীভাবে আসতে পারে নিরাপত্তা

নারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাইবার হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং গ্রামীণ নারীদের জন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত। এই উদ্যোগগুলোর কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব‍্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন বলেন, ‘প্রথমত, নারীদের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাইবার হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা উচিত; বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের জন্য। তৃতীয়ত, নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশাধিকার এবং সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া নারীবান্ধব কনটেন্ট এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করাও গুরুত্বপূর্ণ।’ সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই একটি নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নারীবান্ধব ইন্টারনেট গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন ব‍্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি

  • ডিজিটাল লিটারেসি ক্যাম্পেইন: নারীদের জন্য বিশেষ অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ।
  • সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও পুলিশ ইউনিট শক্তিশালীকরণ: দ্রুত বিচার ও প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য।
  • নারীবান্ধব প্রযুক্তি ডিজাইন: যেমন রিপোর্টিং বাটন, অ্যানোনিমাস সাপোর্ট সিস্টেম।
  • স্কুল পর্যায় থেকে সচেতনতা শিক্ষা: নারীদের কিশোর বয়স থেকে ডিজিটাল অধিকার সম্পর্কে জানানো।

তানভীর হাসান জোহা, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ

সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত