Ajker Patrika

কলাবতী শাড়ির রূপকার দুই নারী

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট ও  মাহিদুল ইসলাম, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) 
কলাবতী শাড়ির রূপকার দুই নারী

প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকে দারুণ সব গল্প। কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি বানানোর সফলতার যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছে, এর পেছনের গল্পটিও দারুণ। অদ্ভুত বিষয়, এ সফলতার পেছনে জড়িয়ে আছে দুই নারীর চিন্তা ও কর্মতৎপরতা। তাঁদের একজন রাধাবতী দেবী, অন্যজন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। 

একজন রাধাবতী দেবী
সংগ্রামমুখর এক জীবন তাঁর। প্রায় ৬৫ বছর আগে কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাধাবতী দেবী। পৃথিবীতে আসার কয়েক মাস পর বাবাকে হারান। ফলে মা মালতী দেবী হয়ে ওঠেন তাঁর ভরসার জায়গা। কিছুদিন পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

ফলে রাধাবতী বড় হন চাচার কাছে। স্থানীয় তেতইগাঁও রশিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সংসারজীবন শুরুর মাত্র তিন মাস পর বিচ্ছেদ হয়ে যায়! ২০১৬ সালে তাঁর মা মারা যান। এত সব বিচ্ছেদ আর বিষণ্নতার গল্প নিয়ে রাধাবতী দেবী বয়ে চলেছেন ৬৬ বছরের জীবন। বর্তমানে চাচাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক রণজিৎ সিংহের পরিবারে থাকেন তিনি। সাধ্যমতো কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন রাধাবতী। সাধারণত সব মণিপুরি নারীই তাঁত বুনতে পারেন। তিনিও এর ব্যতিক্রম 
নন। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি তাঁত বয়নের কাজ শুরু করেন এবং ১৯৯২ সাল থেকে শাড়ি তৈরি শুরু করেন।

এই দীর্ঘ তাঁত বয়নের অভিজ্ঞতা তাঁকে দক্ষ করে তুলেছে। সেই দক্ষতার খোঁজ পান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ফলে এক দারুণ উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখে।

কলাবতী শাড়ি তৈরির পর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে রাধাবতী দেবীকে অর্থসহায়তা এবং একটি স্মার্টফোন উপহার দেওয়া হয়। তবে উপহার আর মজুরির চেয়ে তাঁর 
কাছে আনন্দের বিষয়, তিনি দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন। এ জন্য সরকার, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও ফুফাতো ভাই গুণমনির কাছে ঋণী বলে জানান রাধাবতী দেবী।

 জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির সঙ্গে রাধাবতী দেবীএকটি প্রকল্প এবং ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি 
কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরির পেছনে আছে একটি প্রকল্পের দীর্ঘদিন ধরে নীরবে কাজ করে যাওয়ার গল্প। সেই প্রকল্পটি হলো কলাগাছের আঁশ থেকে বানানো সুতায় হস্তশিল্প তৈরি। এর নেপথ্য কারিগর বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কলাগাছের তন্তু দিয়ে হস্তজাত শিল্প তৈরির এ পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে বান্দরবানে। অফিস-আদালত বা সভা-সেমিনারে ব্যবহারের জন্য ফোল্ডার, ঝুড়ি, শতরঞ্জি, কলমদানি, পাঁচ তারকা হোটেলের কক্ষে পরার জন্য জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে কলাগাছের তন্তু দিয়ে। প্রথম পর্বের কাজে সফলতা এলে এই সুতা দিয়ে কাপড় বা শাড়ি বানানো যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সেই চিন্তার সূত্র ধরে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে তাঁতে কাপড় বোনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে আসে সাফল্য। তবে সেই কাপড় অনেক মোটা আর খসখসে। কিন্তু ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ভাবতে থাকেন, কাপড় যেহেতু বানানো গেছে, আরেকটু চেষ্টা করলে শাড়িও বানানো সম্ভব। এ চিন্তা থেকে অগ্রসর হতে হতে এ বছরের একেবারে শুরুতে শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় রাধাবতী দেবীকে। শাড়ি বানানোর জন্য মৌলভীবাজার থেকে তাঁতও আনা হয়। এতেই আসে সফলতা।

ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘দক্ষ তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবীকে আমরা সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে তৈরি করিয়েছি শাড়িটি। এ জন্য তাঁকে স্মরণ রাখতে শাড়ির নাম দিয়েছি “কলাবতী”। কলাগাছের “কলা” আর রাধাবতীর “বতী” যোগ করে নির্ধারণ করা হয়েছে এই নাম।’

তবে পুরো প্রকল্পকে শতভাগ সফল বলা যায় না এখনো। ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানান, সুতাকে কতটা নমনীয় করা যায়, কীভাবে আরও বেশি সুতা উৎপন্ন করা যায়—এসব নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার। সে কারণে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তাঁত বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠানো হচ্ছে বলেও জানান ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি।

শাড়িটি যেমন
কলাগাছের সুতা থেকে তৈরি শাড়িটি অনেকটা মণিপুরি ও জামদানি শাড়ির মতো অথবা এ দুই শাড়ির মাঝামাঝি। ঘিয়ে রঙের জমিনে লাল ও সবুজ রঙের সুতা দিয়ে নকশা করা হয়েছে শাড়িটি। স্থানীয় পদ্ধতিতে সুতা নরম করার চেষ্টা করা হয়েছে। শাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৮০০ গ্রাম সুতা ব্যবহার করা হয়। শাড়ির পাড় বোনা হয়েছে কোরিয়ান সুতা দিয়ে আর শাড়ির জমিন ও আঁচল তৈরি করা হয়েছে কলাগাছের সুতা দিয়ে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারিগরের মজুরিসহ শাড়ির দাম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হবে।

উদ্যোগ সফল হলে ভালো লাগে সবার। রাধাবতী দেবী কিংবা ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি—দুজনই খানিকটা তৃপ্ত। তাঁরা জানান, কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। এখান থেকে স্থানীয় মানুষ যাতে লাভবান হয়, সে পথ খুঁজে বের করতে হবে।

আমরাও আশায় আছি, একসময় পথের দিশা পাওয়া যাবে। স্থানীয় পরিসরে তো বটেই, একদিন রাধাবতী দেবী কিংবা ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির উত্তরসূরিরা আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যাবেন তাঁদের সফলতার গল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

গাড়ি কেনার টাকা না দেওয়ায় স্ত্রীকে মারধর, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা

মুক্তি পেয়ে আ.লীগ নেতার ভিডিও বার্তা, বেআইনি বলল বিএনপি

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কাও ঢাকায় এসিসির সভা বর্জন করল

যুদ্ধবিমানের ২৫০ ইঞ্জিন কিনছে ভারত, ফ্রান্সের সঙ্গে ৬১ হাজার কোটি রুপির চুক্তি

সালাহউদ্দিনকে নিয়ে বিষোদ্‌গার: চকরিয়ায় এনসিপির পথসভার মঞ্চে বিএনপির হামলা-ভাঙচুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত