Ajker Patrika

ডিজিটাল দুনিয়া বদলে দেওয়া লাইক বাটন এল যেভাবে

অনলাইন ডেস্ক
লাইক বাটনটি সাধারণ, তবে মার্জিত প্রতীক। ছবি: মার টেক
লাইক বাটনটি সাধারণ, তবে মার্জিত প্রতীক। ছবি: মার টেক

ডিজিটাল যুগের নতুন চালিকা শক্তি একটি ছোট্ট ‘লাইক’ বাটন—যা একদিকে যেমন সৃজনশীলতার অনুপ্রেরণা, তেমনি আবার হয়ে উঠেছে আবেগের বোঝা।

ইন্টারনেট দুনিয়া আজকের রূপ পেয়েছে ‘লাইক’ বাটনের বদৌলতে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘লাইক’ বাটনের ব্যবহার প্ল্যাটফর্মগুলোকে এক ধরনের ডিজিটাল নেশায় পরিণত করেছে। ২০২১ সালে কোম্পানির নাম পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত ফেসবুকের সিলিকন ভ্যালির সদর দফতরের সামনে থাকা বিশাল আকারের এই প্রতীকটি একসময় পরিণত হয়েছিল আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণে।

এই ছোট্ট প্রতীকের জটিল ইতিহাস উঠে এসেছে ‘লাইক: দ্য বাটন দ্য চেঞ্চড দ্য ওর্য়াল্ড’ নামক এক বইতে। বইটি আমাদের নিয়ে যায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াইয়ের যুগে, সেখান থেকে আবার পাঠকের মনোযোগ ফিরিয়ে আনে প্রযুক্তি বিপ্লবের কেন্দ্র সিলিকন ভ্যালিতে।

বইটিতে উঠে এসেছে, প্রযুক্তি জগতের পথপ্রদর্শকরা কীভাবে ‘রেকগনিশন’–কে একটি ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করে একে মানুষের অনলাইন অংশগ্রহণ ও কনটেন্ট তৈরির প্রেরণায় রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। এই ধারণার প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন ইয়েলপ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা রাস সিমন্স, টুইটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিজ স্টোন, পেপালের সহপ্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স লেভচিন, ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ চেন এবং জিমেইলের উদ্ভাবক পল বুকহেইট।

২০০৫ সালের ১৮ মে, ইয়েলপ-এর একজন কর্মী বব গুডসন একটি কাগজে আঙুল উপরে তোলা ও নিম্মমুখী করে রাখার দুটি সাধারণ চিত্র আঁকেন, যেন রেস্টুরেন্ট রিভিউয়ে ব্যবহারকারীরা সহজেই তাদের মতামত জানাতে পারেন। তবে গুডসনের প্রস্তাবিত প্রতীকটি গ্রহণ করেনি ইয়েলপ, বরং রাস সিমন্সের তৈরি ‘ইউজফুল’, ‘ফানি’ এবং ‘কুল’ বাটনগুলো ব্যবহার করে। বহু বছর পর পুরোনো স্কেচটি আবার সামনে হলে লাইক বাটন নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জাগায় গুডসনের। সেই আগ্রহ থেকেই গুডসন ও মার্টিন রিভস একসঙ্গে ‘লাইক’ বাটনের উদ্ভব ও বিবর্তনের পেছনের গল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং প্রকাশ করেন তাদের বই।

রিভস বলেন, ‘লাইক বাটনটি সাধারণ, তবে মার্জিত প্রতীক। এর মর্মাথ হলো—‘আমি তোমাকে পছন্দ করি, আমি তোমার কনটেন্ট পছন্দ করি। কারণ আমি তোমার মতো।’ তবে ‘লাইক বাটনের আবিষ্কারক কে?’ এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর বের করা অনেক কঠিন।

ফেসবুক এই প্রতীককে জনপ্রিয় করে তুললেও তারা এর উদ্ভাবন করেনি। বরং প্রথমে এটিকে ‘তুচ্ছ’ ভেবে বাতিল করে দিয়েছিল ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুক প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে এটি যুক্ত হয়।

এই প্রতীকের পেছনের গল্প একক কোনো ব্যক্তির নয়। প্রয়োজনীয়তা খাতিরেই এই বাটন তৈরি হয়েছে। সিলিকন ভ্যালিতে এক দশক ধরে এই ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছিল। রিভস বলেন, ‘উদ্ভাবন অনেক সময় সামাজিক প্রক্রিয়া। সিলিকন ভ্যালি সেই জায়গা যেখানে মানুষ নিয়মিত একত্র হয়ে তাদের কাজ নিয়ে কথা বলে। তখন অনেকেই এই ধরনের প্রতীকের ধারণা নিয়ে কাজ করছিল।’

ইয়েলপ ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীদের ফিডব্যাক দেওয়ার সহজ উপায় হিসেবে এই প্রতীকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। তবে গুডসনের সেই আঁকা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমার সম্রাট কমোডাসের (অভিনয়ে জোকুইন ফিনিক্স) হাতে ওপরের বা নিচের দিকে আঙুল দেখানোর মধ্য দিয়ে জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার চিত্র এর পেছনে প্রভাব রাখতে পারে। আবার এর চেয়েও আগে, ১৯৭০-এর দশকের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘হ্যাপি ডেস’-এ হেনরি উইঙ্কলারের চরিত্র ‘ফনজি’ আঙুল তুলে ‘ঠিক আছে’ বোঝাতেন। পরবর্তীকালে টিভো নামক ভিডিও রেকর্ডারে এই প্রতীক যুক্ত হয় প্রোগ্রাম পছন্দের জন্য। একই সময়ে ‘হট ওর নট’ নামের এক ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের চেহারার ওপর অন্যদের মতামত জানতে চাইত, যা লাইক বাটনের ধারণাকে অনুপ্রাণিত করে।

তাই লাইক বাটন ব্যবহার করার অনুপ্রেরণা কোনো একক মুহূর্তে জন্ম নেয়নি, বরং এটি সময়ের ধারায় নানা সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত এবং মনস্তাত্ত্বিক উৎস থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।

এছাড়া ডিগ, জ্যাঙ্গা, ইউটিউব, ভিমিও—এ ধরনের অনেক প্ল্যাটফর্মই ভূমিকা রেখেছে এই প্রতীকের বিবর্তনে।

২০০৭ সালের দিকে ফেসবুকের ইঞ্জিনিয়াররা ‘লাইক’ বাটন নিয়ে কাজ করছিলেন। সেসময় জাকারবার্গ মনে করতেন এটি সাইটটিকে ‘অগোছালো’ করে ফেলবে এবং সেবাটির গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ন হবে। তাই প্রথমে ফেসবুকে এই বাটন যুক্ত করার পক্ষে ছিলে না জাকারবার্গ।

তবে প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফ্রেন্ডফিড লাইক বাটন ব্যবহার নিয়ে কোনো দ্বিধায় পড়েনি। ২০০৭ সালের অক্টোবরেই নিজেদের তৈরি একটি লাইক বাটন চালু করে প্ল্যাটফর্মটি। উল্লেখ্য, মার্কিন সফটওয়্যার প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা এবং প্রোগ্রামার বুখহেইট এবং বর্তমানে ওপেনএআই এর চেয়ারম্যান ব্রেট টেইলর এই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করে।

ফ্রেন্ডফিড–এর এই উদ্যোগ সফল হয়নি। লাইক বাটনটি জনপ্রিয়তা পায়নি এবং শেষ পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মটি টিকে থাকতে না পেরে ফেসবুকের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

এই অধিগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ফেসবুক নিজেই লাইক বাটন চালু করে দেয়। যদিও শুরুতে এই বাটনের নাম ‘ওয়াসম’ (Awesome) বাটন রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত লাইক বাটনটি রাখতে রাজি হয় জাকারবার্গ। ফেসবুক দ্রুতই বুঝে যায় যে ‘লাইক’ বাটন শুধু ব্যবহারকারীদের বেশি সময় প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখতে সহায়তা করছে না, বরং এটি মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বুঝে নেওয়ারও কার্যকর উপায় হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর আগ্রহ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যা ফেসবুক (বর্তমানে মেটা প্ল্যাটফর্মস) লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন বিক্রি করতে ব্যবহার করে। যেখান থেকে ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৬৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

২০১৬ সালে ফেসবুক এই প্রতীকের সঙ্গে আরও ছয়টি আবেগ সংযুক্ত করে—‘লাভ’, ‘কেয়ার’, ‘হাহা, ‘ওয়াও’ এবং ‘অ্যাংগ্রি’

লেভচিনের মতে, ‘মানুষ কোন কনটেন্ট পছন্দ করে—এটি ইন্টারনেটের সবচেয়ে মূল্যবান তথ্য।’

তবে এর নেতিবাচক দিকও কম নয়। কিশোর-কিশোরীরা পোস্টে লাইক না পেলে মানসিক চাপে পড়ে, আর যারা অতিমাত্রায় প্রশংসা চান তারা হয়ে ওঠেন আত্মকেন্দ্রিক। রিভস বলেন, ‘আপনি যদি ভালো দিকগুলোই সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে না পারেন, তাহলে কিভাবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর সমাধান করার প্রক্রিয়াগুলো আগে থেকেই বুঝবেন?’

তবুও, রিভস বিশ্বাস করেন যে, ‘লাইক’ বাটন এবং এর পেছনে যেসব শক্তি একত্র হয়েছিল, তা মানবজাতির একটি মৌলিক ও স্বতন্ত্র প্রবৃত্তিকে স্পর্শ করেছে।

তিনি বলেন, ‘উদ্ভাবনের এই আকস্মিকতাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের প্রশংসা জানানো ও ভালো লাগা প্রকাশ করা সহজেই হারিয়ে যাবে না, কারণ এটি আমাদের ১ লাখ বছরের বিবর্তনের ফসল।’

তথ্যসূত্র: জাপান টুডে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জামায়াতের অফিসে আগুন নেভাতে গিয়ে কোরআন শরিফ দেখেননি, দাবি ফায়ার সার্ভিসের

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স: রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আসন নেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর

দিনাজপুরে নিহত মাইক্রোবাস-আরোহীদের সবাই সরকারি কর্মকর্তা

ফরিদপুরে গাড়ির চাকায় ছিন্নভিন্ন অজ্ঞাত ব্যক্তি, অক্ষত শুধু পায়ের জুতা

নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার বিব্রতকর: উপদেষ্টা ফারুকী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত