Ajker Patrika

২৫০০ বছর আগে কেমন ছিল দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের চেহারা, দেখালেন বিজ্ঞানীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১১: ১৯
প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মানুষের মুখচ্ছবি ডিজিটালি পুনর্গঠন করছেন। ছবি: ফেস ল্যাব
প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মানুষের মুখচ্ছবি ডিজিটালি পুনর্গঠন করছেন। ছবি: ফেস ল্যাব

আড়াই হাজার বছর আগের দুটি পুরুষের খুলির মুখাবয়ব আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আবারও ‘জীবন্ত’ করে তোলা হয়েছে। এই ডিজিটাল পুনর্গঠন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর প্রাচীন বাসিন্দারা দেখতে কেমন ছিলেন, তার যেমন ধারণা দেয়, তেমনি তাদের বংশগতি ও পূর্বপুরুষের ইতিহাস সম্পর্কেও তুলে ধরে দুর্লভ তথ্য।

তামিলনাড়ুর মধুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌতূহলী গবেষকেরা ২ হাজার ৫০০ বছর আগের একটি দাঁতের ওপরে থাকা এনামেল সরিয়ে নেন একটি ক্ষুদ্র ড্রিল ব্যবহার করে। দাঁতটি দুটি মানুষের খুলির মধ্যে একটির, যা ব্যবহার করে তাঁরা প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মানুষের মুখচ্ছবি ডিজিটালি পুনর্গঠন করছেন।

কোন্ডাগাই নামের একটি প্রাচীন কবরস্থান থেকে এ দুই পুরুষের খুলি উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানটি কিলাড়ি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার (২.৫ মাইল) দূরে অবস্থিত, যেখানে সাম্প্রতিক খননকার্য দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে এবং যা ভারতের রাজনীতিতেও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

তামিলনাড়ু রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষকদের দাবি, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ সালে কিলাড়িতে এক নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই দাবি ভারতের উপমহাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করছে। এত দিন পর্যন্ত ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ধারণা মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের সিন্ধু সভ্যতার (৫ হাজার বছরের পুরোনো) ওপর ভিত্তি করে তৈরি ছিল।

তবে কিলাড়ির আবিষ্কার বলছে, দক্ষিণ ভারতেও একটি স্বতন্ত্র ও উন্নত প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, কিলাড়ির মানুষ ছিল শিক্ষিত, দক্ষ এবং তারা উপমহাদেশ ও বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করত। তারা ইটের বাড়িতে বাস করত এবং মৃতদের কবর দেওয়ার সময় বিশাল কবরে মাটির হাঁড়িতে চাল, শস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য রাখত।

এখন পর্যন্ত কোন্ডাগাই সমাধি থেকে প্রায় ৫০টি পাত্র উদ্ধার করা হয়েছে, যাতে পাওয়া গেছে মানুষের দেহাবশেষ এবং জীবনের নানা নিদর্শন। মধুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এখন এসব হাড় ও দ্রব্য থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণ করছেন, যাতে বোঝা যায় কিলাড়ির মানুষ আসলে কারা ছিল এবং কীভাবে জীবনযাপন করত।

গবেষণার প্রধান অধ্যাপক জি. কুমারেসান বলেন, ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিবাসনের পথ ও উৎস সম্পর্কে জানতে চাই। এই গবেষণা আমাদের অস্তিত্বের মূল প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার একটি প্রয়াস।’

কোন্ডাগাই থেকে পাওয়া দুটি খুলি নিয়ে গবেষকেরা প্রথমে ত্রিমাত্রিক (৩ ডি) স্ক্যান তৈরি করেন। এই স্ক্যান পাঠানো হয় যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস ল্যাবে, যারা ফরেনসিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মুখ পুনর্গঠন বিশেষজ্ঞ।

সেখানে সফটওয়্যারের সাহায্যে খুলির ওপর পেশি, চামড়া ও অন্যান্য মুখের বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে মুখচ্ছবি তৈরি করা হয়। সবকিছুই মানবদেহের গড় গঠন ও অনুপাত অনুযায়ী করা হয়।

কোন্ডাগাই সমাধি থেকে প্রায় ৫০টি পাত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ছবি: তামিলনাড়ু রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
কোন্ডাগাই সমাধি থেকে প্রায় ৫০টি পাত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ছবি: তামিলনাড়ু রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চেহারায় রং যোগ করা—তাদের ত্বকের বাদামি রঙের কোন শেড হবে, চোখের রং কী হবে, চুল কেমন হবে। অধ্যাপক কুমারেসান জানান, এ ক্ষেত্রে আধুনিক তামিলনাড়ুর মানুষের গড় শারীরিক বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করা হয়, যদিও চূড়ান্ত প্রতিচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

এই প্রতিচিত্র ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জাতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ঘিরে বিভাজনকে সামনে এনে দেয়। অনেকেই মনে করেন, আর্যরা (যারা মূলত ভারতের উত্তর অংশে বসবাস করত) ভারতের মূল বাসিন্দা। অন্যদিকে, দ্রাবিড়রা (দক্ষিণ ভারতের মানুষের বর্ণনা দিতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়) দাবি করেন, তারাই আদি অধিবাসী।

অধ্যাপক কুমারেসান বলেন, এই মুখচ্ছবিগুলো দেখায় যে, বাস্তবতা আরও জটিল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। আমরা ভাবি যা, তার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় আমাদের পরিচয়। তার প্রমাণ আমাদের ডিএনএতে লুকিয়ে রয়েছে।

তিনি জানান, খুলিগুলোর মুখে ‘প্রাচীন দ্রাবিড়ীয়’ বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে কিছু মধ্যপ্রাচ্য ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক বৈশিষ্ট্যও আছে, যা থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী অভিবাসন ও সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

গবেষকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন ডিএনএ সংগ্রহ করা। কঙ্কালগুলো খুবই ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় ডিএনএর মান খারাপ ও অল্প। তবু অধ্যাপক কুমারেসান আশাবাদী, কিছু ফলপ্রসূ তথ্য পাওয়া যাবে।

লিভারপুল ফেস ল্যাবের প্রধান ক্যারোলিন উইলকিনসন বলেন, ‘মানুষ হিসেবে আমরা মুখাবয়ব নিয়ে সব সময়ই কৌতূহলী। এটি আমাদের সামাজিক জীব হিসেবে সফল হওয়ার একটি প্রধান উপাদান। মুখচ্ছবিগুলো দেখিয়ে দেয়, প্রাচীন কঙ্কাল কেবল নিদর্শন নয়, তারা ছিল জীবন্ত মানুষ। এর মাধ্যমে মানুষ ইতিহাসের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত সংযোগ অনুভব করতে পারে।’

প্রফেসর কুমারেসান বলেন, ‘আমরা জেনেছি, কিলাড়ির মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন ও বাণিজ্যে জড়িত ছিল। তারা হরিণ, ছাগল ও বুনো শুয়োর পালন করত এবং প্রচুর চাল ও মিলেট খেত।’

তিনি আরও জানান, আজকের তামিলনাড়ুতে খেজুরগাছ সচরাচর দেখা না গেলেও তারা খেজুরও খেতেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত