Ajker Patrika

যেসব কারণে পুরুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে নারী

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪০
খাদ্য ও চিকিৎসার পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া সত্ত্বেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি দিন বাঁচে। ছবি: প্রাইম ওমেন
খাদ্য ও চিকিৎসার পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া সত্ত্বেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি দিন বাঁচে। ছবি: প্রাইম ওমেন

মহামারি, দুর্ভিক্ষ কিংবা দাসত্বের মতো কঠিন সময়েও পুরুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে নারীরা। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। নারীদেহ গঠিত হয়েছে সহনশীলতা, স্থায়িত্ব ও দীর্ঘায়ুর জন্য। জটিল প্রজননব্যবস্থা, মাসিক চক্র, গর্ভধারণ, প্রসব ও স্তন্যদানের মতো শারীরিক চাপ সত্ত্বেও নারীরা শুধু তা সামালই দেন না, বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনধারণে পুরুষদেরও ছাপিয়ে যান। এই আশ্চর্য জীব বৈজ্ঞানিক শক্তির পেছনে রয়েছে জেনেটিক গঠন, হরমোন, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও জীবনধারার মতো বেশ কিছু কারণ।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, খাদ্য ও চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া সত্ত্বেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি দিন বাঁচে। বিষয়টি উঠে এসেছে ‘দ্য স্ট্রংগার সেক্স’ বইয়ের গবেষণায়।

ইতালির ইউনিভার্সিটি অব পাডুয়ার ডেমোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ভার্জিনিয়া জারুল্লি সাতটি ঐতিহাসিক দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেঁচে থাকার হার বিশ্লেষণ করেন। তাঁর ২০১৮ সালের গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে’ (পিএনএএস)।

গবেষণায় দেখা যায়, ইউক্রেন, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেনের দুর্ভিক্ষ, ত্রিনিদাদে দাসত্ব এবং আইসল্যান্ডের হাম মহামারির মতো ‘উচ্চ মৃত্যুহার’ পরিবেশেও সব বয়সের নারী বেশি দিন বেঁচেছে। এমনকি এই চরম সময়ে জন্ম নেওয়া কন্যাশিশুরাও পুত্রশিশুর চেয়ে বেশি টিকে ছিল—এটি নারীর জৈবিক সহনশীলতার শক্ত ইঙ্গিত।

এক্স ক্রোমোজোম

নারীদের শরীরে থাকে দুটি এক্স ক্রোমোজোম, যেখানে পুরুষের একটিই থাকে। এক্স ক্রোমোজোমে থাকে প্রায় ১০ গুণ বেশি জিন, যেসবের মধ্যে অনেকগুলো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। নিউরোজেনেটিসিস্ট ও বিবর্তনবিদ ড. শ্যারন মোলেম তাঁর বই ‘দ্য বেটা হাফ: অন দ্য জেনিটিক সুপিয়রিটি অব ওমেন’-এ বলেন, ‘যেহেতু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া নিরন্তর বিবর্তিত হয়, সেভাবে নারীদের প্রতিরোধব্যবস্থা পুরুষদের তুলনায় দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

পুরুষের তুলনায় নারীদের শরীরে বেশি পরিমাণে থাকে ইস্ট্রোজেন, যা রোগ প্রতিরোধে বাড়তি সুবিধা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদেহে থাকে উচ্চসংখ্যক নিউট্রোফিল, যেটি সবচেয়ে প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ শ্বেত রক্তকণিকা। এ ছাড়া তাদের ‘বি’ সেল কার্যক্রমও পুরুষদের চেয়ে বেশি সক্রিয়, ফলে তারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

নারীরা সংক্রমণের বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘ সময় ধরে রোগের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী প্রফেসর মারলিন জুক বলেন, ‘পুরুষেরা অনেক রোগে নারীর তুলনায় বেশি দুর্বল হয়; যদিও তা সব রোগে বা সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’

টেস্টোস্টেরনের প্রভাব

নারীদের তুলনায় পুরুষদের শরীরে বেশি থাকে টেস্টোস্টেরন, যা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ প্রাণী থেকে টেস্টোস্টেরন বের করে নিলে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার স্ত্রী প্রাণীর শরীরে অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন প্রবেশ করালেও সেই ক্ষমতা কমে যায়।

জুক বলেন, ‘সম্ভবত টেস্টোস্টেরন পুরুষ প্রাণীকে বেশি বংশবিস্তার করতে সহায়তা করে। তবে এর বিনিময়ে তাদের শরীরের স্থায়িত্ব কমে যায়।’

জীবনধারা ও সংস্কৃতির প্রভাব

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, পুরুষদের কম দীর্ঘায়ুর পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণও ভূমিকা রাখে। পুরুষেরা তুলনামূলকভাবে বেশি ধূমপান করেন, বেশি অ্যালকোহল পান করেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। অনেক সময় তাঁরা নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে রাখেন।

তবে জারুল্লির গবেষণায় দেখা যায়, এমনকি যখন নারী-পুরুষের জীবনধারা প্রায় এক হয়, তখনো নারীরাই বেশি দিন বাঁচে।

অন্ত্রের দৈর্ঘ্যেও নারীর সুবিধা

২০২৩ সালে ‘পিয়ারজে’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের ক্ষুদ্রান্ত্র পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বড়। ১৮৮৫ সালের পর এই প্রথম মৃতদেহের অন্ত্রের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজিস্ট এরিন ম্যাককেনি ও ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজিস্ট আমান্ডা হেল।

নারীদের শরীরে খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি, বিশেষ করে প্রোটিন ও চর্বি—শোষণের ক্ষমতা বেশি। গর্ভধারণ ও স্তন্যদানের সময় এই পুষ্টির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। গবেষক হেল বলেন, ‘নারীর ছোট অন্ত্রই তার শরীরকে আরও দক্ষভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে।’

এই বৈজ্ঞানিক তথ্য ‘ফিমেল বাফারিং হাইপোথিসিস’-এর পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, যা বলছে নারীর শরীর পরিবেশগত ও শারীরিক চাপ মোকাবিলায় বেশি সক্ষম।

অনেক বছর ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞান নারী শরীরের জটিলতা ও বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করেছে। এখন জিন, হরমোন ও শারীরিক কাঠামো নিয়ে গবেষণায় নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু নারীর জন্য নয়, বরং সব শরীরের জন্য আরও লক্ষ্যভিত্তিক ও কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরি সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত