উচ্চশিক্ষার প্রসারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দেশে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রীতে আজকের পত্রিকার সভাকক্ষে আয়োজিত ‘উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা: বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের বিভিন্ন অভিমত উঠে এসেছে।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থাকা উচিত
ড. মো. সবুর খান, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থাকা উচিত, এটা সত্য। পিএইচডি পলিসি (নীতিমালা) হয়ে গেছে, কিন্তু তা সার্কুলেট হচ্ছে না। অনেকে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রে দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংগতি তুলে ধরেন। কিন্তু দু-একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সবগুলোকে বিবেচনা করা ঠিক নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুযোগ দিতে হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ দিতে হবে। চাকরির বাজারে তারা কীভাবে ভূমিকা রাখছে, সেটা দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ট্যাক্সে অবদান রাখছে, সেটা নিয়েও সার্ভে হতে পারে। আমাদের শিক্ষকেরা ট্যাক্স দিচ্ছেন, কর্মকর্তারা ট্যাক্স দিচ্ছেন। কেনাকাটার ভেতরেও আমরা ট্যাক্স-ভ্যাট দিচ্ছি। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরেও ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীরা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তারা কতটুকু ট্যাক্স দিচ্ছে, এটা অনেকে জানে না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, গত পাঁচ বছরে বিলো ফোরটি টপ ট্যাক্সপেয়ার যারা, তারা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বিদেশি শিক্ষার্থী আমাদের দেশে কম আসছে। কিন্তু যে কয়জন আসছে, সেটা নিয়ে আমাদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিছু শিক্ষার্থী যে এ দেশে আসে, তাদেরকে স্যালুট করা উচিত।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ভালো জব করছে। কারণ, তারা তো বাই ডিফল্ট মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্টগুলো পাচ্ছে। তাদের পড়াশোনা হচ্ছে, না হচ্ছে, সেটা বিষয় নয়। তাদের এক্সট্রা কালিকুলার অ্যাকটিভিটিস কী? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছেন শিক্ষকেরা। এতে তুলনামূলক বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সৃজনশীল কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। তারা গবেষণা করছে। তার নতুন নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাগুলোতে যাচ্ছে। অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যাচ্ছে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান থাকতে হবে
ড. এস এম হাফিজুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল/পিএইচডি ডিগ্রি চালু নিয়ে নানা মত রয়েছে। এটাই বাস্তবতা। কারণ, কিছু নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়েছে। আমি এ-সংক্রান্ত একটি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছি। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু কাজ করেছি। পরিকল্পনা রয়েছে, শিগগির একটি কর্মশালা ও ফিজিবিলিটি স্টাডি করার।
শুধু ইউনিভার্সিটির র্যাঙ্কিংয়ের চিন্তা করলে হবে না; আমাদের চিন্তা করতে হবে এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে। ইন্ডাস্ট্রি র্যাঙ্কিং নিয়ে এক দশকে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু খুব যে উন্নতি হয়েছে, তা আমার মনে হয় না।
এসডিএ ডাইমেনশনে আমরা বারবার বলছি কোয়ালিটি এডুকেশনের কথা। তবে এটাতে এখন পরিবর্তন এসেছে। এখন বলা হচ্ছে নলেজ। যা আগে ছিল এসডিএ ডাইমেনশনের এডুকেশন। যে ইউনিভার্সিটি নলেজ ক্রিয়েট করতে পারবে, তারাই এগিয়ে থাকবে। আর নলেজ ক্রিয়েট করতে হবে রিসার্চের মাধ্যমে।
কোন ইউনিভার্সিটি কত টাকা খরচ করছে গবেষণায়? এটি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আসা উচিত। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ইউনিভার্সিটির অবদান থাকতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে। পাবলিক-প্রাইভেট সব ইউনিভার্সিটিতে কোয়ালিটি এস্যুরেন্সে আরও কাজ করতে হবে। তাহলে আমরা মানসম্মত মানুষ পাব। যারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ যে বিষয়গুলো অ্যাপলাইড, সে বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পড়তে চায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু নন-অ্যাপলাইড বিষয় চালু হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-অ্যাপলাইড বিষয় চালু হয়েছে। এটায় একটা ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয়।
মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া কঠিন
অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া, উপাচার্য, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান বুঝতে হবে। আমি যদি ভালো মানের জিনিস না পাই, যতই আমি প্রক্রিয়াকরণ করি, সেখান থেকে ভালো ফল আসে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়েও কথা বলা দরকার। কারণ, এটাই আমাদের ভিত্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বোঝা উচিত। এখানে সরকারি-বেসরকারি দুটো ভাগ করা চরম বোকামি। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো না চলে, তাহলে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে আপনাকে স্বাধীনতা দিতে হবে। আমাকে হাত-পা বেঁধে দিয়ে বলবেন সাঁতরাও, আরেকজনকে ছেড়ে দিয়ে বলবেন, প্রতিযোগিতায় যাও, তা হতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দিলে দেখা যাবে, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কঠিন যে সমস্যার সম্মুখীন আমরা হই, সেটা হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া; যা অত্যন্ত কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু পেতে হবে তো। যারা ভালো ভালো ফিল্ডে পিএইচডি করছে, তাদের দেশে ফিরে আসার প্রবণতা অনেক কম। মেধাবী শিক্ষার্থীদের আমরা হারাচ্ছি। এদেরকেই আমাদের দরকার। আমরা ভালো বেতন দিয়েও শিক্ষক পাচ্ছি না। আমাদের চেষ্টার কমতি আছে, তা নয়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো পিএইচডির সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাহলে রিসার্চ করবে কে? মাস্টার্সে খুব বেশি শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। মাস্টার্স করার একটা ভালো পরিবেশ তৈরি করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত
অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসেফিক
তথ্যপ্রবাহের যুগে শিক্ষার্থীরা অনেক তথ্য নিয়ে আসছে। কিন্তু কোন শিক্ষার্থী আসছে? বুয়েটে যে শিক্ষার্থী যাচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীকে আমরা পাচ্ছি না। আমাদের এই জায়গাটা বুঝতে হবে। সাধারণত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যম গ্রুপের শিক্ষার্থীদের পাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এটা আরও কঠিন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এই উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের যে মানসম্পন্ন শিক্ষক দরকার, সেই শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না।
পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়টি এখন আর দাবির পর্যায়ে নেই। আমরা সত্যিই তৃষ্ণার্ত। কিসের জন্য তৃষ্ণার্ত? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম থাকা প্রয়োজন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিনীত অনুরোধ করেছি, আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি দিন। আমি প্রস্তাব দিয়েছি, প্রোগ্রামভিত্তিক হলেও পিএইচডি দিন। একটা ইউনিভার্সিটিতে যদি চারটা প্রোগ্রাম থাকে, আটটা প্রোগ্রাম থাকে, নয়টা প্রোগ্রাম থাকে; তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী অন্তত পিএইচডি করার সুযোগ দিন। পিএইচডি থাকলে আমাদের শিক্ষকেরা পিএইচডি করতে পারবেন। অন্যরাও আসবেন। আমাদের দেশে এখনো এই কালচার যে শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যই দেশে পিএইচডি করা হয়।
যদি শিক্ষার্থীদের কাঁচামাল বলি, তাহলে শিক্ষকদের দক্ষ শ্রমিক বলতে হবে। শিক্ষকদের সেই দক্ষতা গড়ে তোলার বিষয়টা আছে। এই দক্ষতায় আমরা যেন পিছিয়ে না পড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যেন আমরা ব্যবহার করি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুনলে আমরা জাত গেল, জাত গেল বলে চিৎকার করছি। আসলে জাত যাবে না। মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তাটাকে কীভাবে উন্নত করা যায়, সেই ক্ষেত্রে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে পারি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী পেতে হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছোট করে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে
অধ্যাপক ড. এম আশিক মোসাদ্দিক, উপ–উপাচার্য, ইষ্ট–ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আরেকটু ভালো শিক্ষার্থীরা আসে, তাহলে তাদের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে আরেকটু সুবিধা হয়। আমি বিশ্বাস করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জব মার্কেটের জন্য প্রস্তুত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
অনার্স মাস্টার্স করেই কেউ শিক্ষক হয়ে গেলেন, তা নয়। শিক্ষক হওয়ার জন্য একটা প্রসিডিউর আছে। সেই প্রশিক্ষণটা তাঁর দরকার যে কীভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের একটা মার্কেটের জন্য যোগ্য করে তুলবেন। সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষিত করা যায়।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরে যখন ছাত্রছাত্রীর চাপ ছিল, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে এসেছে। ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা করা হয়। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের জমি এবং ২৫ হাজার বর্গফুটের ভবন থাকতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আস্তে আস্তে নিজেদের মূল ভবনে যাচ্ছে। যারা এখনো যেতে পারেনি, তারাও চেষ্টা করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্ভাবনা অনেক ভালো। গবেষণা এবং পিএইচডির ক্ষেত্রে কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা অনেক বেশি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, যেগুলো কলেজ হওয়ারও যোগ্য নয়। শুধু সরকারি হওয়ার কারণে সেগুলো যদি পিএইচডি অফার করতে পারে, সেটাকে আমি অন্যায় বলব। সরকারি বা বেসরকারি নয়, একই মানদণ্ডে দেখতে হবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি অফার করতে পারবে আর কে পারবে না। তাহলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটা মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষার পেছনে খরচের মানসিকতায় বদল চাই
অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, উপ–উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি
একটি গবেষণায় দেখেছি, ভর্তুকি যোগ করা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে যে খরচ, তা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। ফ্রি হোস্টেল এবং ইউটিলিটিজ বিল যদি যোগ করা হয়, তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একজনকে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করতে হলে আমেরিকায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা লাগে। যেখানে বাংলাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু আট লাখ টাকা লাগে। তাহলে কোনটি কম ব্যয়বহুল? বিদেশ নাকি বাংলাদেশ? এখানে মূল সমস্যাটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। অভিভাবকদের সক্ষমতার বিষয় আছে এবং সচেতনতার বিষয় আছে। শিক্ষার পেছনে খরচের যে মানসিকতা, তা কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেটার জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যাতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়ে সময়ে ফি পুনর্নির্ধারণ করতে পারে এবং ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে।
একজন পিএইচডি করা শিক্ষক সাধারণত দেশে আসতে চান না। তাহলে আমরা কীভাবে আন্তর্জাতিক মান মেইনটেইন করব? এ জন্য আমরা হিমশিম খাচ্ছি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটা অলিগোপলিস্টিক কমপিটিশন চলছে। যেমন এক জায়গায় একজন আছেন, তাঁকে ২০ হাজার ৫০ হাজার বেশি দিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের কোনো উপকার হচ্ছে না। তিনি বাংলাদেশের ভেতরেই থাকছেন; বরং আমাদের দেখতে হবে, কীভাবে এ দেশের ভালো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া যায়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয়টা বেশি কোন সেন্সে? অ্যাকচুয়াল সেন্সে, নাকি সাবসিডাইজড সেন্সে? অ্যাকচুয়াল সেন্সে ব্যয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কম। যেহেতু আমাদের কোনো সরকারি সাবসিডি নেই। সাবসিডি বিবেচনায় নেওয়া হলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ বেসরকারির চেয়ে বেশি হবে।
সমাজের প্রয়োজনটাও অনুধাবন করতে হবে
শামসুল আলম লিটন, ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সাইয়েন্স এন্ড টেকনোলজি
দীর্ঘ ২০ বছর পশ্চিমে বসবাস করে দেখেছি, ‘অপরচুনিটি’, ‘কোয়ালিটি অ্যাকসেস’ এই শব্দগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। ভোকেশনাল ট্রেইনিং ও মানসম্মত নয়। অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটিতে আমরা সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরিয়েন্টেন্ড সাবজেক্ট নিয়ে শুরু করেছিলাম।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোশ্যাল সায়েন্স এবং আর্টসের সাবজেক্টগুলো শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ পড়ে থাকে। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন সেগুলো বন্ধ করে দিতে হলো, এটা একটা বড় ইস্যু। কারণ, ওখানে ফ্যাকাল্টি আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক জানতে চায়, কারা ইন্ডাস্ট্রি এবং মার্কেট এমপ্লয়মেন্ট সম্পর্কে সচেতন। তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সোশ্যাল সায়েন্স এবং আর্টসের সাবজেক্টগুলো বন্ধ করে দিতে হবে? অথবা প্রাইভেটে ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হবে? মূলকথা হচ্ছে, আমরা আসলে সোসাইটির আলটিমেট প্রয়োজনটা অনুধাবন করছি কি না? এই জায়গাটা নিয়ে কারও কাজ করার সুযোগ হয়নি। কারণ, হয়তো এই জায়গাটায় লাভ-ক্ষতির সুযোগ কম।
আমরা পুলিশ এবং প্রশাসনে পিএইচডি দেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লেজারিজমের উৎপাত দেখি। যখন পিএইচডির সাবজেক্টের একটু ডিটেইলে যাই, তখন দেখি কচুরিপানার নানা দিক নিয়ে বেশি পিএইচডি হয়েছে। এত পিএইচডি দিয়ে আমরা আসলে কী করব? এটা সবকিছুর জন্য প্রযোজ্য নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা অ্যাভারেজ রেজাল্ট করছে, তারাও পিএইচডিতে সুযোগ পাচ্ছে। কীভাবে পাচ্ছে, সেটাও দেখা দরকার।
আমরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় দখল দেখেছি। ভবিষ্যতে আমরা যেন রাজনৈতিক চাপে না পড়ি। আমি মনে করি, ৫ আগস্ট থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে।
শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, ট্যাক্স—এগুলো একটা বিষয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত যে পরিসীমা, সেখানে তাদের অবস্থানটা কোথায়। এর অর্থটাও তাদের বুঝতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষতা উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে
অধ্যাপক মো. শামসুল হুদা, ট্রেজারার, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন শুরু হলো, তখন সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানেরা তাদের সামর্থ্যের জায়গা থেকে এই সুযোগটা নিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা এমনভাবে আকৃষ্ট করতে শুরু করল যে এখন নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আমরা উচ্চশিক্ষায় পাচ্ছি, যেটি হয়তো আগে কল্পনাও করা যেত না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে তারা এখন উচ্চশিক্ষায় বৈশ্বিকভাবে চাহিদাসম্পন্ন বিষয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস শিক্ষার্থীর সমাজে কোনো অবস্থান নেই। চাকরির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত প্রতিযোগিতা, সেখানে ৪০-৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর সুযোগ হয় না। অথচ আমরা গত দুই বছরের পরিসংখ্যান যদি দেখি, প্রায় সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক অতিক্রম করে এসেছে। এদের যদি আমরা উচ্চশিক্ষার জায়গায় অথবা ভোকেশনাল অথবা টেকনিক্যাল কোনো জায়গায় সম্পৃক্ত না করি, সমাজে এই পর্যায়ে এই যুব শক্তি ডিমান্ড বেইজড যে কর্মসংস্থানগুলো আছে, সেই জায়গায় যদি তাদের নিয়ে যেতে না পারি, সেলেবল প্রোডাক্ট হিসেবে যদি তাদের তৈরি করতে না পারি, তবে তা জাতির জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে স্কিল ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে যাচ্ছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই ধারায় যেতে পারেনি। একজন শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোন বিষয়ে পড়বে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা সম্ভব নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুঁকি অনেক বেশি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে মুনাফা করার সুযোগ কোথায়? বৈষম্যমূলকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাক্স বসানো হয়েছিল। আয়ই যার নেই, সে কেন ট্যাক্স দেবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা অনুদান বাড়ানো দরকার
অধ্যাপক মো. আসাদ উল্লাহ-আল-হোসেন, উপদেষ্টা, ইংরেজি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা অনুদান বাড়ানো দরকার। যে অনুদান দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবহেলা করা হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিচ্ছে না। কিছু শিক্ষার্থী দেখলাম, ৩ দশমিক ৯ নিয়ে পাস করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভা দিতে গিয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে তাদের সরাসরি বাদ দেওয়া হলো। এটা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে যে এত রেজাল্ট ভালো, তবু শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে নেওয়া হচ্ছে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে আমি দেখেছি, শিক্ষকেরা দিনরাত কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তাঁরা যোগাযোগ রাখছেন। গবেষণাতেও তাঁরা খুব ভালো অবদান রাখছেন। জার্নালগুলোতেও তাঁদের কাজ যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাঁরা আরও ভালো করতেন।
পিএইচডির ক্ষেত্রে অবশ্যই কোয়ালিটি দেখা উচিত। আমি দেখেছি, আমারই ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে বা করে এসেছে। কিন্তু সেখানে তো আমি মান দেখছি না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নাক উঁচু ভাব’ লক্ষণীয়।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখি, শুধু ভাইভা নিয়েই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
আমাদের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি মাত্র পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যেই তাদের অগ্রগতি অনেক। ওখানে শিক্ষকের সংখ্যা হয়তোবা কম। ডিপার্টমেন্ট পাঁচ-ছয়টা। ফ্যাকাল্টি তিন-চারটা। তারপরেও আমাদের অগ্রগতি কম নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও কৃতিত্ব অনেক
অধ্যাপক এ এম এম হামিদুর রহমান, ইংরেজি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
প্রতিষ্ঠানের মান, শিক্ষা প্রদানের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী বের করতে না পারি, যদি শিক্ষার মান সেই জায়গায় না যায়, তাহলে কখনোই আমাদের শিক্ষার্থীরা সফল হবে না, চাকরি পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অর্জিত হবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আইটিএসসি আছে। আমাদের প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট শিক্ষার মান আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সচেষ্ট। আমরা অনেক সমস্যার কথা বলেছি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও কৃতিত্ব অনেক।
যদি কিউ এস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং দেখি, টাইমস হায়ার র্যাঙ্কিং দেখি, আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি। দেশে এবং সমগ্র বিশ্বে। এরই মধ্যে আমরা শিক্ষার উন্নতির জন্য এইচআরডিআইয়ের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষকদের অনেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমাদের ফিউচার ড্যাফোডিল বলে একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। যেখানে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, সামনে কী করব। আমরা এই কোয়ালিটি আরও কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব, সেই চেষ্টা করছি।
আমাদের ২২০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন, আর তিনজন বিদেশি শিক্ষক রয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের অনুমতি পেয়েছে। দুবাইয়ে আমাদের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একটি শাখা চালু হচ্ছে। শিগগির তার অবকাঠামোর কাজ শুরু হবে। আইটিএসসি এবং অন্যান্য কাজ সাফল্যের সঙ্গে করছি। ভবিষ্যতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য হবে, এটাই আমরা আশা করি।
যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন
আলোচক
ড. মো. সবুর খান
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া
উপাচার্য
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
উপাচার্য
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
অধ্যাপক ড. এম আশিক মোসাদ্দিক
উপ-উপাচার্য
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী
উপ-উপাচার্য
উত্তরা ইউনিভার্সিটি
মো. শামসুল আলম লিটন
ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান
অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
অধ্যাপক মো. শামসুল হুদা
ট্রেজারার
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক মো. আসাদ উল্লাহ-আল-হোসেন
উপদেষ্টা, ইংরেজি বিভাগ
ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক এ এম এম হামিদুর রহমান
ইংরেজি বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
স্বাগত বক্তব্য
কামরুল হাসান
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
সঞ্চালনা
সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী
উপসম্পাদক
আজকের পত্রিকা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থাকা উচিত
ড. মো. সবুর খান, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থাকা উচিত, এটা সত্য। পিএইচডি পলিসি (নীতিমালা) হয়ে গেছে, কিন্তু তা সার্কুলেট হচ্ছে না। অনেকে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রে দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংগতি তুলে ধরেন। কিন্তু দু-একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সবগুলোকে বিবেচনা করা ঠিক নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুযোগ দিতে হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ দিতে হবে। চাকরির বাজারে তারা কীভাবে ভূমিকা রাখছে, সেটা দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ট্যাক্সে অবদান রাখছে, সেটা নিয়েও সার্ভে হতে পারে। আমাদের শিক্ষকেরা ট্যাক্স দিচ্ছেন, কর্মকর্তারা ট্যাক্স দিচ্ছেন। কেনাকাটার ভেতরেও আমরা ট্যাক্স-ভ্যাট দিচ্ছি। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরেও ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীরা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তারা কতটুকু ট্যাক্স দিচ্ছে, এটা অনেকে জানে না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, গত পাঁচ বছরে বিলো ফোরটি টপ ট্যাক্সপেয়ার যারা, তারা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বিদেশি শিক্ষার্থী আমাদের দেশে কম আসছে। কিন্তু যে কয়জন আসছে, সেটা নিয়ে আমাদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিছু শিক্ষার্থী যে এ দেশে আসে, তাদেরকে স্যালুট করা উচিত।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ভালো জব করছে। কারণ, তারা তো বাই ডিফল্ট মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্টগুলো পাচ্ছে। তাদের পড়াশোনা হচ্ছে, না হচ্ছে, সেটা বিষয় নয়। তাদের এক্সট্রা কালিকুলার অ্যাকটিভিটিস কী? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছেন শিক্ষকেরা। এতে তুলনামূলক বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সৃজনশীল কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। তারা গবেষণা করছে। তার নতুন নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাগুলোতে যাচ্ছে। অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যাচ্ছে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান থাকতে হবে
ড. এস এম হাফিজুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল/পিএইচডি ডিগ্রি চালু নিয়ে নানা মত রয়েছে। এটাই বাস্তবতা। কারণ, কিছু নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়েছে। আমি এ-সংক্রান্ত একটি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছি। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু কাজ করেছি। পরিকল্পনা রয়েছে, শিগগির একটি কর্মশালা ও ফিজিবিলিটি স্টাডি করার।
শুধু ইউনিভার্সিটির র্যাঙ্কিংয়ের চিন্তা করলে হবে না; আমাদের চিন্তা করতে হবে এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে। ইন্ডাস্ট্রি র্যাঙ্কিং নিয়ে এক দশকে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু খুব যে উন্নতি হয়েছে, তা আমার মনে হয় না।
এসডিএ ডাইমেনশনে আমরা বারবার বলছি কোয়ালিটি এডুকেশনের কথা। তবে এটাতে এখন পরিবর্তন এসেছে। এখন বলা হচ্ছে নলেজ। যা আগে ছিল এসডিএ ডাইমেনশনের এডুকেশন। যে ইউনিভার্সিটি নলেজ ক্রিয়েট করতে পারবে, তারাই এগিয়ে থাকবে। আর নলেজ ক্রিয়েট করতে হবে রিসার্চের মাধ্যমে।
কোন ইউনিভার্সিটি কত টাকা খরচ করছে গবেষণায়? এটি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আসা উচিত। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ইউনিভার্সিটির অবদান থাকতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে। পাবলিক-প্রাইভেট সব ইউনিভার্সিটিতে কোয়ালিটি এস্যুরেন্সে আরও কাজ করতে হবে। তাহলে আমরা মানসম্মত মানুষ পাব। যারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ যে বিষয়গুলো অ্যাপলাইড, সে বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পড়তে চায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু নন-অ্যাপলাইড বিষয় চালু হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-অ্যাপলাইড বিষয় চালু হয়েছে। এটায় একটা ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয়।
মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া কঠিন
অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া, উপাচার্য, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান বুঝতে হবে। আমি যদি ভালো মানের জিনিস না পাই, যতই আমি প্রক্রিয়াকরণ করি, সেখান থেকে ভালো ফল আসে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়েও কথা বলা দরকার। কারণ, এটাই আমাদের ভিত্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বোঝা উচিত। এখানে সরকারি-বেসরকারি দুটো ভাগ করা চরম বোকামি। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো না চলে, তাহলে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে আপনাকে স্বাধীনতা দিতে হবে। আমাকে হাত-পা বেঁধে দিয়ে বলবেন সাঁতরাও, আরেকজনকে ছেড়ে দিয়ে বলবেন, প্রতিযোগিতায় যাও, তা হতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দিলে দেখা যাবে, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কঠিন যে সমস্যার সম্মুখীন আমরা হই, সেটা হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া; যা অত্যন্ত কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু পেতে হবে তো। যারা ভালো ভালো ফিল্ডে পিএইচডি করছে, তাদের দেশে ফিরে আসার প্রবণতা অনেক কম। মেধাবী শিক্ষার্থীদের আমরা হারাচ্ছি। এদেরকেই আমাদের দরকার। আমরা ভালো বেতন দিয়েও শিক্ষক পাচ্ছি না। আমাদের চেষ্টার কমতি আছে, তা নয়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো পিএইচডির সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাহলে রিসার্চ করবে কে? মাস্টার্সে খুব বেশি শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। মাস্টার্স করার একটা ভালো পরিবেশ তৈরি করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত
অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসেফিক
তথ্যপ্রবাহের যুগে শিক্ষার্থীরা অনেক তথ্য নিয়ে আসছে। কিন্তু কোন শিক্ষার্থী আসছে? বুয়েটে যে শিক্ষার্থী যাচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীকে আমরা পাচ্ছি না। আমাদের এই জায়গাটা বুঝতে হবে। সাধারণত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যম গ্রুপের শিক্ষার্থীদের পাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এটা আরও কঠিন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এই উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের যে মানসম্পন্ন শিক্ষক দরকার, সেই শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না।
পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়টি এখন আর দাবির পর্যায়ে নেই। আমরা সত্যিই তৃষ্ণার্ত। কিসের জন্য তৃষ্ণার্ত? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম থাকা প্রয়োজন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিনীত অনুরোধ করেছি, আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি দিন। আমি প্রস্তাব দিয়েছি, প্রোগ্রামভিত্তিক হলেও পিএইচডি দিন। একটা ইউনিভার্সিটিতে যদি চারটা প্রোগ্রাম থাকে, আটটা প্রোগ্রাম থাকে, নয়টা প্রোগ্রাম থাকে; তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী অন্তত পিএইচডি করার সুযোগ দিন। পিএইচডি থাকলে আমাদের শিক্ষকেরা পিএইচডি করতে পারবেন। অন্যরাও আসবেন। আমাদের দেশে এখনো এই কালচার যে শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যই দেশে পিএইচডি করা হয়।
যদি শিক্ষার্থীদের কাঁচামাল বলি, তাহলে শিক্ষকদের দক্ষ শ্রমিক বলতে হবে। শিক্ষকদের সেই দক্ষতা গড়ে তোলার বিষয়টা আছে। এই দক্ষতায় আমরা যেন পিছিয়ে না পড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যেন আমরা ব্যবহার করি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুনলে আমরা জাত গেল, জাত গেল বলে চিৎকার করছি। আসলে জাত যাবে না। মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তাটাকে কীভাবে উন্নত করা যায়, সেই ক্ষেত্রে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে পারি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী পেতে হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছোট করে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে
অধ্যাপক ড. এম আশিক মোসাদ্দিক, উপ–উপাচার্য, ইষ্ট–ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আরেকটু ভালো শিক্ষার্থীরা আসে, তাহলে তাদের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে আরেকটু সুবিধা হয়। আমি বিশ্বাস করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জব মার্কেটের জন্য প্রস্তুত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
অনার্স মাস্টার্স করেই কেউ শিক্ষক হয়ে গেলেন, তা নয়। শিক্ষক হওয়ার জন্য একটা প্রসিডিউর আছে। সেই প্রশিক্ষণটা তাঁর দরকার যে কীভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের একটা মার্কেটের জন্য যোগ্য করে তুলবেন। সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষিত করা যায়।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরে যখন ছাত্রছাত্রীর চাপ ছিল, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে এসেছে। ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা করা হয়। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের জমি এবং ২৫ হাজার বর্গফুটের ভবন থাকতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আস্তে আস্তে নিজেদের মূল ভবনে যাচ্ছে। যারা এখনো যেতে পারেনি, তারাও চেষ্টা করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্ভাবনা অনেক ভালো। গবেষণা এবং পিএইচডির ক্ষেত্রে কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা অনেক বেশি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, যেগুলো কলেজ হওয়ারও যোগ্য নয়। শুধু সরকারি হওয়ার কারণে সেগুলো যদি পিএইচডি অফার করতে পারে, সেটাকে আমি অন্যায় বলব। সরকারি বা বেসরকারি নয়, একই মানদণ্ডে দেখতে হবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি অফার করতে পারবে আর কে পারবে না। তাহলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটা মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষার পেছনে খরচের মানসিকতায় বদল চাই
অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, উপ–উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি
একটি গবেষণায় দেখেছি, ভর্তুকি যোগ করা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে যে খরচ, তা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। ফ্রি হোস্টেল এবং ইউটিলিটিজ বিল যদি যোগ করা হয়, তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একজনকে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করতে হলে আমেরিকায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা লাগে। যেখানে বাংলাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু আট লাখ টাকা লাগে। তাহলে কোনটি কম ব্যয়বহুল? বিদেশ নাকি বাংলাদেশ? এখানে মূল সমস্যাটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। অভিভাবকদের সক্ষমতার বিষয় আছে এবং সচেতনতার বিষয় আছে। শিক্ষার পেছনে খরচের যে মানসিকতা, তা কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেটার জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যাতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়ে সময়ে ফি পুনর্নির্ধারণ করতে পারে এবং ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে।
একজন পিএইচডি করা শিক্ষক সাধারণত দেশে আসতে চান না। তাহলে আমরা কীভাবে আন্তর্জাতিক মান মেইনটেইন করব? এ জন্য আমরা হিমশিম খাচ্ছি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটা অলিগোপলিস্টিক কমপিটিশন চলছে। যেমন এক জায়গায় একজন আছেন, তাঁকে ২০ হাজার ৫০ হাজার বেশি দিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের কোনো উপকার হচ্ছে না। তিনি বাংলাদেশের ভেতরেই থাকছেন; বরং আমাদের দেখতে হবে, কীভাবে এ দেশের ভালো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া যায়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয়টা বেশি কোন সেন্সে? অ্যাকচুয়াল সেন্সে, নাকি সাবসিডাইজড সেন্সে? অ্যাকচুয়াল সেন্সে ব্যয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কম। যেহেতু আমাদের কোনো সরকারি সাবসিডি নেই। সাবসিডি বিবেচনায় নেওয়া হলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ বেসরকারির চেয়ে বেশি হবে।
সমাজের প্রয়োজনটাও অনুধাবন করতে হবে
শামসুল আলম লিটন, ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সাইয়েন্স এন্ড টেকনোলজি
দীর্ঘ ২০ বছর পশ্চিমে বসবাস করে দেখেছি, ‘অপরচুনিটি’, ‘কোয়ালিটি অ্যাকসেস’ এই শব্দগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। ভোকেশনাল ট্রেইনিং ও মানসম্মত নয়। অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটিতে আমরা সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরিয়েন্টেন্ড সাবজেক্ট নিয়ে শুরু করেছিলাম।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোশ্যাল সায়েন্স এবং আর্টসের সাবজেক্টগুলো শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ পড়ে থাকে। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন সেগুলো বন্ধ করে দিতে হলো, এটা একটা বড় ইস্যু। কারণ, ওখানে ফ্যাকাল্টি আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক জানতে চায়, কারা ইন্ডাস্ট্রি এবং মার্কেট এমপ্লয়মেন্ট সম্পর্কে সচেতন। তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সোশ্যাল সায়েন্স এবং আর্টসের সাবজেক্টগুলো বন্ধ করে দিতে হবে? অথবা প্রাইভেটে ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হবে? মূলকথা হচ্ছে, আমরা আসলে সোসাইটির আলটিমেট প্রয়োজনটা অনুধাবন করছি কি না? এই জায়গাটা নিয়ে কারও কাজ করার সুযোগ হয়নি। কারণ, হয়তো এই জায়গাটায় লাভ-ক্ষতির সুযোগ কম।
আমরা পুলিশ এবং প্রশাসনে পিএইচডি দেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লেজারিজমের উৎপাত দেখি। যখন পিএইচডির সাবজেক্টের একটু ডিটেইলে যাই, তখন দেখি কচুরিপানার নানা দিক নিয়ে বেশি পিএইচডি হয়েছে। এত পিএইচডি দিয়ে আমরা আসলে কী করব? এটা সবকিছুর জন্য প্রযোজ্য নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা অ্যাভারেজ রেজাল্ট করছে, তারাও পিএইচডিতে সুযোগ পাচ্ছে। কীভাবে পাচ্ছে, সেটাও দেখা দরকার।
আমরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় দখল দেখেছি। ভবিষ্যতে আমরা যেন রাজনৈতিক চাপে না পড়ি। আমি মনে করি, ৫ আগস্ট থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে।
শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, ট্যাক্স—এগুলো একটা বিষয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত যে পরিসীমা, সেখানে তাদের অবস্থানটা কোথায়। এর অর্থটাও তাদের বুঝতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষতা উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে
অধ্যাপক মো. শামসুল হুদা, ট্রেজারার, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন শুরু হলো, তখন সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানেরা তাদের সামর্থ্যের জায়গা থেকে এই সুযোগটা নিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা এমনভাবে আকৃষ্ট করতে শুরু করল যে এখন নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আমরা উচ্চশিক্ষায় পাচ্ছি, যেটি হয়তো আগে কল্পনাও করা যেত না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে তারা এখন উচ্চশিক্ষায় বৈশ্বিকভাবে চাহিদাসম্পন্ন বিষয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস শিক্ষার্থীর সমাজে কোনো অবস্থান নেই। চাকরির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত প্রতিযোগিতা, সেখানে ৪০-৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর সুযোগ হয় না। অথচ আমরা গত দুই বছরের পরিসংখ্যান যদি দেখি, প্রায় সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক অতিক্রম করে এসেছে। এদের যদি আমরা উচ্চশিক্ষার জায়গায় অথবা ভোকেশনাল অথবা টেকনিক্যাল কোনো জায়গায় সম্পৃক্ত না করি, সমাজে এই পর্যায়ে এই যুব শক্তি ডিমান্ড বেইজড যে কর্মসংস্থানগুলো আছে, সেই জায়গায় যদি তাদের নিয়ে যেতে না পারি, সেলেবল প্রোডাক্ট হিসেবে যদি তাদের তৈরি করতে না পারি, তবে তা জাতির জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে স্কিল ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে যাচ্ছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই ধারায় যেতে পারেনি। একজন শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোন বিষয়ে পড়বে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা সম্ভব নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুঁকি অনেক বেশি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে মুনাফা করার সুযোগ কোথায়? বৈষম্যমূলকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাক্স বসানো হয়েছিল। আয়ই যার নেই, সে কেন ট্যাক্স দেবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা অনুদান বাড়ানো দরকার
অধ্যাপক মো. আসাদ উল্লাহ-আল-হোসেন, উপদেষ্টা, ইংরেজি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা অনুদান বাড়ানো দরকার। যে অনুদান দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবহেলা করা হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিচ্ছে না। কিছু শিক্ষার্থী দেখলাম, ৩ দশমিক ৯ নিয়ে পাস করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভা দিতে গিয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে তাদের সরাসরি বাদ দেওয়া হলো। এটা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে যে এত রেজাল্ট ভালো, তবু শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে নেওয়া হচ্ছে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে আমি দেখেছি, শিক্ষকেরা দিনরাত কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তাঁরা যোগাযোগ রাখছেন। গবেষণাতেও তাঁরা খুব ভালো অবদান রাখছেন। জার্নালগুলোতেও তাঁদের কাজ যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাঁরা আরও ভালো করতেন।
পিএইচডির ক্ষেত্রে অবশ্যই কোয়ালিটি দেখা উচিত। আমি দেখেছি, আমারই ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে বা করে এসেছে। কিন্তু সেখানে তো আমি মান দেখছি না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নাক উঁচু ভাব’ লক্ষণীয়।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখি, শুধু ভাইভা নিয়েই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
আমাদের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি মাত্র পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যেই তাদের অগ্রগতি অনেক। ওখানে শিক্ষকের সংখ্যা হয়তোবা কম। ডিপার্টমেন্ট পাঁচ-ছয়টা। ফ্যাকাল্টি তিন-চারটা। তারপরেও আমাদের অগ্রগতি কম নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও কৃতিত্ব অনেক
অধ্যাপক এ এম এম হামিদুর রহমান, ইংরেজি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটি
প্রতিষ্ঠানের মান, শিক্ষা প্রদানের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী বের করতে না পারি, যদি শিক্ষার মান সেই জায়গায় না যায়, তাহলে কখনোই আমাদের শিক্ষার্থীরা সফল হবে না, চাকরি পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অর্জিত হবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আইটিএসসি আছে। আমাদের প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট শিক্ষার মান আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সচেষ্ট। আমরা অনেক সমস্যার কথা বলেছি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও কৃতিত্ব অনেক।
যদি কিউ এস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং দেখি, টাইমস হায়ার র্যাঙ্কিং দেখি, আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি। দেশে এবং সমগ্র বিশ্বে। এরই মধ্যে আমরা শিক্ষার উন্নতির জন্য এইচআরডিআইয়ের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষকদের অনেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমাদের ফিউচার ড্যাফোডিল বলে একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। যেখানে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, সামনে কী করব। আমরা এই কোয়ালিটি আরও কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব, সেই চেষ্টা করছি।
আমাদের ২২০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন, আর তিনজন বিদেশি শিক্ষক রয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের অনুমতি পেয়েছে। দুবাইয়ে আমাদের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একটি শাখা চালু হচ্ছে। শিগগির তার অবকাঠামোর কাজ শুরু হবে। আইটিএসসি এবং অন্যান্য কাজ সাফল্যের সঙ্গে করছি। ভবিষ্যতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য হবে, এটাই আমরা আশা করি।
যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন
আলোচক
ড. মো. সবুর খান
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া
উপাচার্য
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
উপাচার্য
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
অধ্যাপক ড. এম আশিক মোসাদ্দিক
উপ-উপাচার্য
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী
উপ-উপাচার্য
উত্তরা ইউনিভার্সিটি
মো. শামসুল আলম লিটন
ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান
অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
অধ্যাপক মো. শামসুল হুদা
ট্রেজারার
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক মো. আসাদ উল্লাহ-আল-হোসেন
উপদেষ্টা, ইংরেজি বিভাগ
ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি
অধ্যাপক এ এম এম হামিদুর রহমান
ইংরেজি বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
স্বাগত বক্তব্য
কামরুল হাসান
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
সঞ্চালনা
সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী
উপসম্পাদক
আজকের পত্রিকা
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এই অগ্রযাত্রায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বড় অবদান রাখছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বাদ দিলে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন।
৬ দিন আগে